মেহেদী হাসান সোহাগ(মাদারীপুর): মাদারীপুরের শিবচর, রাজৈর ও কালকিনিতে ক্লিনিক সিন্ডিকেট’এর মাধ্যমে একটি প্রভাবশালী মহল আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সকল ক্লিনিকের অধিকাংশরই নেই সরকারি কোন অনুমোদন। অতি মুনাফালোভী এ মহলটি সিন্ডিকেট গড়ে তাদের খেয়াল খুশি মত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সব ক্লিনিকে রয়েছে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র। যারা বিভিন্ন স্থান ও সরকারী হাসপাতাল থেকে রোগী ফুঁসলিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যায়। তাদের দেয়া হয় দালালীর অংশ। ক্লিনিকগুলোতে একের পর এক রোগী মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভুমিকা নিরব রয়েছে। শুধু তাই নয় এ সংক্রান্ত একাধিক মর্মান্তিক সংবাদ বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, শিবচর, রাজৈর, রাজৈরের টেকেরহাট ও কালকিনি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাহারী নামের মোট ১৭টি ক্লিনিক ও অর্ধশতাধিক প্যাথলজি সেন্টার রয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় গজিয়ে উঠেছে এ সব ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টার। এখানে সেবার নামে যারা চিকিৎসা দিচ্ছে তাদের ৯০ ভাগই অদক্ষ। ক্লিনিকের ম্যানেজার অর্থপেডিক ও সার্জন, এখানে নার্স গাইনি বিশেষজ্ঞ, আয়া হচ্ছে সিনিয়র স্টাফ নার্স আর ব্রাদার এনেস্থেসিয়া। এভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাকে ডগায় চলছে তুঘলকি কারবার। যে কারণে একের পর এক রোগি মারা যাচ্ছে। কোন কোন ঘটনা টাকা পয়সা দিয়েই ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে। কোনটা প্রভাব খাটিয়ে, আবার কোন কোনটা ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপা দেয়া হচ্ছে।
যারা এসব ঘটনার শিকার তাদের অধিকাংশই ক্ষেত মজুর, দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের লোক। গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে কমপক্ষে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের নাম ঠিকানা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
শিবচর মেডিপ্যাথ ক্লিনিকেই গত তিন মাসে মাধুরী পাল (২৫) , আনোয়ারা বেগম (৩৫), বৃষ্টি আক্তার (২২) তিনজন মারা গেছে। এদের মৃত্যুর পেছনে রয়েছে শিবচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. আব্দুল মোতালেব মিয়া ও ঢাকার ডা. জান্নাত আরা ফেরদৌস।
বেলা ১১টা বাজলেই ডা. আব্দুল মোতালেব মিয়া সরকারী হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে বাণিজ্যে চলে যান। তার এনেস্থেসিয়ার প্রশিক্ষণ না থাকলেও তিনি এনেস্থেসিয়ার কাজ করে থাকেন।
কোন মুমূর্ষ রোগীর সিজারের সময় সরকারী হাসপাতালের এনেস্থেসিয়া ডা. কাওসার আহম্মেদকে তলব না করে তিনি নিজেই এনেস্থেসিয়ার কাজ করেন। শিবচর মেডিপ্যাথ ক্লিনিকে ২৭ মার্চ সিজারের পুর্বে ইনজেকশন দেয়ার সাথে সাথে বাচ্চাসহ বৃষ্টি আক্তার নামে এক প্রসুতি মারা গেলে বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার পর ক্লিনিকের মালিক ফজলুল হক মিয়া কিছুক্ষণ গা ঢাকা দিলেও আবার রাতেই জনসম্মুখে চলে আসেন। বৃষ্টির পরিবারের অভিযোগে পুলিশ ক্লিনিকের ম্যানেজর শাহজালাল মিয়া, নার্স সাথী আক্তার ও দালাল শাহনাজ আক্তারকে আটক করে অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে দেয়।
গত ২১ মার্চ কালকিনি মডার্ন হাসপাতালে মারা যায় রাজদী গ্রামের হাবিব খলিফার ছেলে নয়ন খলিফা (১১)। তাকে মৃত অবস্থায় তরিঘরি করে এ্যাম্বুলেন্স এ তুলে রেফার করা হয় বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া সম্প্রতি রাজৈরের টেকেরহাট নিউ জমজম হাসপাতালে সন্তানসহ মারা যায় নন্দিতা মন্ডল নামের এক প্রসূতি।
টেকেরহাট জেনারেল হাসপাতালে অপারেশন টেবিলেই মারা যায় টুম্পা আক্তার নামের এক প্রসূতি। সিজার করে শিশুকে বের করার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। মৃত অবস্থায় তাকে রেফার করা হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জন্মের পরই টুম্পার সন্তান হয় মাতৃহারা। টুম্পা হত্যার বিচারের দাবিতে তার মা বিউটি বেগম তৎকালীন সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। টুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে বিচারের দাবীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে এলাকাবাসী।
সাবেক সিভিল সার্জন অভিযোগটি তদন্তের জন্য রাজৈর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করেন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একটি প্রহসনের তদন্ত করে দায় এড়িয়ে যান। এ পর্যন্ত ভুল চিকিৎসা ও অদক্ষতার কারণে যত রোগী মারা গেছে তার কোনটিরই বিচার হয়নি।
বৃষ্টির মামা ইয়াছিন হাওলাদার অভিযোগ করেন, বৃষ্টিকে শুক্রবার দুপুরে মেডিপ্যাথ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। বিকেলে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএসএ ডা. মোতালেব মিয়ার উপস্থিতিতে দুটি ইনজেকশন পুশ করে ক্লিনিকের নার্স সাথী আক্তার। এর পর পরই বৃষ্টির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
শিবচর থানার উপ-পরিদর্শক (এএসআই) নিউটন দত্ত জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই ক্লিনিকের ম্যানেজার শাহজালাল মিয়া, নার্স সাথী আক্তার ও দালাল শাহানাজ বেগমকে আটক করা হয়েছে।
মাদারীপুর সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ কুমার দাস বলেন, বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে, রাজৈরে দুটি মামলাও হয়েছে। আমার বিভিন্ন সময় তদন্ত কমিটি করে দেই। সমস্যা হচ্ছে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সাথে টাকা পয়সার বিনিময়ে সমাধান হয়ে যাওয়ার কারনে তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগকারীরা সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেনা। তাছাড়া কোন এধরনের ঘটনা ঘটলে প্রভাবশালীরা এগিয়ে আসে। চার্জসীট দেয়ার সময় পুলিশ বিপাকে পড়ে। ফলে মামলা ও অভিযোগগুলোর কোন সত্যতা পাওয়া যায় না। এমনও তথ্য পাওয়া গেছে রোগি মারা গেছে অপারেশন টেবিলে অথচ তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগকারীরা বলেছেন রোগি মারা গেছে বরিশাল বা ফরিদপুর যাওয়ার পথে।
Discussion about this post