নয় বছর পর বহুল আলোচিত সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৬-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আজ বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) মন্ত্রিসভার বৈঠকে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এতে বিধান রাখা হয়েছে যে, সরকারি কাজ করতে গিয়ে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে আদালত চার্জশিট গ্রহণের আগে তাকে গ্রেফতার করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুদক যে কাউকে যে কোনো সময়ে গ্রেফতার করতে পারবে। তবে ব্যক্তিগত কারণে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হলে সরকার তার দায় নেবে না। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি ছাড়াই চার্জশিটের আগে ওই কর্মচারীকে গ্রেফতার করা যাবে।
ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের এই বিশেষ সুবিধা অন্য কোনো পেশার ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এমনকি মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষেত্রেও নয়। সাংবিধানিক পদ, বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্ক্ষলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ আইনের আওতায় পড়বেন না। সরকারি কাজে কর্মচারীদের আরও উৎসাহিত করতে এমন বিধান রাখা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা মনে করছেন, আইনটি প্রণয়ন হলে দেশে সাংবিধানিক বৈষম্য সৃষ্টি হবে। কারণ, এ আইনে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে পাশ কাটিয়ে শুধু সরকারি কর্মচারীদের একটি বিশেষ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে এ বিধান রাখা হয়েছে।
রাজনীতি ও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন: খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কর্মচারীদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তারা কঠোর অনুশাসন মেনে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সহকর্মীদের সঙ্গে সহমর্মিতাবোধ বজায় রাখবেন। আইন অনুযায়ী এ দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকবেন তারা। কাজকর্মে উৎসাহ দিতে জনসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য সরকারি কর্মচারীদের পুরস্কার ও স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছে আইনটিতে।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো কর্মচারীর ক্ষতি হলে বা কেউ তাকে দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ওই কর্মচারী আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। খসড়া আইন অনুযায়ী, যথোপযুক্ত সংস্থা কোনো কর্মচারীর দায়িত্ব পালন-সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগ তদন্ত করতে এবং আদালতে অভিযোগ করতে পারবেন। তবে সরকারি কাজ করতে গিয়ে কোনো কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হলে তার চার্জশিট আদালত গ্রহণের আগেই তাকে গ্রেফতার করতে চাইলে সরকারকে জানাতে হবে।
কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করার পর তা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হলে ওই কর্মচারী অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারবেন।
চাকরিকাল, বহাল, পুনর্বহাল ও অব্যাহতি: কোনো কর্মচারী যে কোনো সময়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে পারবেন। তবে সরকার নির্ধারণ করবে, কীভাবে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। চলতি নিয়মে ২৫ বছরের আগে কেউ চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারতেন না। খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী আদালকে দণ্ডিত হলে তাকে চাকরিতে বহাল রাখার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।
পদোন্নতি ও পদায়ন: কর্মচারীদের পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন বিধি নির্ধারণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে মেধা ও জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের দাবি ছিল, পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান চালু করা। খসড়া আইনে তা আমলে নেওয়া হয়নি। এ আইনে সরকারি
কর্মকর্তাদের এসিআরের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এসিআরের নম্বর দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজের এসিআর নম্বর সঙ্গে সঙ্গেই জেনে নিতে পারবেন। কোনো অনিয়মের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।
সংবিধানে যা আছে: ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে, এই উদ্দেশ্য আইন দ্বারা বা অধীন বিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত অনুরূপ কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করে বিধিসমূহ প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে এবং অনুরূপ যে-কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে অনুরূপ বিধিসমূহ কার্যকর হইবে’।
প্রেক্ষাপট: স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও সাংবিধানিক অঙ্গীকার ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ কোনো সরকার বাস্তবায়ন করেনি। বিভিন্ন সরকারের মনগড়া বিধিমালা দিয়ে চলছে পুরো প্রশাসন। এ বিধিমালার অজুহাতে বিভিন্ন সরকার প্রশাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এভাবে প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে। প্রশাসনের একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভ, অসন্তোষ থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে প্রশাসনযন্ত্র। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রশাসনকে গতিশীল করার সরকারি কোনো উদ্যোগই কাজ দিচ্ছে না।
এ অবস্থায় সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার প্রশাসনকে গতিশীল করতে ২০০৭ সালে ইউএনডিপির সহায়তায় এই অ্যাক্টের একটি খসড়া তৈরি করে। পরে এটি আর চূড়ান্ত হয়নি। মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আবার নতুন করে একটি আইন তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জনপ্রশাসন (সাবেক সংস্থাপন) মন্ত্রণালয় থেকে সিভিল সার্ভিস আইনের একটি খসড়াও তৈরি করা হয়। পরে এটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে এটি সংশোধন করে নতুন খসড়া তৈরির জন্য সচিব কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশ অনুসারে সচিব কমিটি ইতিমধ্যে সাতটি বৈঠক করে খসড়া চূড়ান্ত করে সচিব কমিটি। পরে অজানা কারণে খসড়াটি বাতিল হয়। পরে সরকার ঘোষণা করে, সিভিল সার্ভিস আইন নয়, সরকারি কর্মচারী আইন তৈরি করা হবে। এ জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটি একাধিক বৈঠক, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে।
গত বছর ১৩ জুলাই সরকারি কর্মচারী আইন মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন খসড়াটিতে ফৌজদারি কোনো মামলায় সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বিধান রাখা হয়। এতে সমলোচনার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় আইনটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে তারা প্রায় এক বছর পর্যালোচনা শেষে ফেরত পাঠিয়েছে। এ সময় আইন মন্ত্রণালয় আইনটির কয়েকটি ধারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আরও স্পষ্ট করতে বলে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কয়েক দফা বৈঠক করে ধারাগুলো স্পষ্ট করে খসড়া চূড়ান্ত করে। পরে আইন মন্ত্রণালয়ে এটির ভেটিং সম্পন্ন হয়। এখন এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে পাঠানো হয়েছে।
কর্মকর্তাদের বক্তব্য: এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য এটি পাঠানো হয়েছে। আইনটি সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি মাইলফলক।’
তিনি জানান, ফৌজদারি মামলা হলে কর্মচারীদের গ্রেফতারে সরকারের অনুমোদনের ধারাটি স্পষ্ট করা রয়েছে। বলা হয়েছে, সরকারি কাজ করতে গিয়ে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর আদালত চার্জশিট গ্রহণের আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে। সূত্র: সমকাল
Discussion about this post