সাহাদাত হোসেন পরশ ও ওয়াকিল আহমেদ হিরন
সন্দেহজনকভাবে কাউকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ যে নীতিমালা দিয়েছেন তা যুগান্তকারী বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এ নীতিমালা মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। তবে এ নির্দেশনা অনুসরণের ক্ষেত্রে রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া এ নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ-র্যাবকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করাও সহজ নয়। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদেরও। মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজ দীর্ঘদিন থেকে এ দুটি ধারার নির্বিচার প্রয়োগের বিরোধিতা করছেন।
এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আদালতের যে কোনো আদেশ মান্য করা তাদের কর্তব্য। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে যে নীতিমালা দেওয়া হয়েছে তা তারা পালন করবেন। তারা এও বলছেন, আইন করার পাশাপাশি তা কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠায় মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ কাঠামো দরকার। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ নির্দেশনা অনুসরণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের জন্য সহজ হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে হয়রানি ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন বন্ধ করার ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনাগ্রহ দূর করতে যেমন বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। র্যাব-পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা এমনকি খুনিদের চাপে পড়ে এসব ধারা প্রয়োগ করে। সুশীল সমাজ মনে করে, নির্দেশনা লঙ্ঘন হলে আদালত স্বপ্রণোদিত পদক্ষেপ নিতে পারেন। এতে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ১৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নীতিমালা অবিলম্বে সব থানা, কর্মকর্তা ও ইউনিটপ্রধানের কাছে প্রচারের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, আদালতের যে কোনো নির্দেশনা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পালন করে থাকে। আপিল বিভাগ থেকে যে নীতিমালা দেওয়া হয়েছে তা পালনের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হবে না।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালার অনুলিপি এখনও হাতে পাইনি। আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেই আলোকে কাজ করা হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, এ রায় যুগান্তকারী। এই রায় মানতে সকলেই বাধ্য। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ড নেওয়ার বিষয়ে নানা অভিযোগ ছিল। মৌলিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এ দুটি ধারা অন্তরায়। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশনার পর অযথা আর কেউ হয়রানি হবেন না, এমন প্রত্যাশা করছি। রায় বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় সরকারের বাস্তবায়ন করা উচিত। তা না হলে জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার সংরক্ষণ করা যাবে না। রায় বাস্তবায়নে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই। সবই সদিচ্ছার ব্যাপার।’
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, রায়টি যুগান্তকারী। জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় রায়টি মাইলফলক। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। পুলিশের নির্যাতনের কারণে যদি কারও মৃত্যু হয় তাহলে ওই পুলিশের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় এই রায়টি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ৫৪ ধারায় পুলিশকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। যে কোনো মানুষকে সন্দেহজনকভাবে অথবা অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছে, এই সন্দেহে আটক করা হতো।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেছেন, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের ক্ষমতা ফৌজদারি কার্যবিধিতে দেওয়া আছে। বলা আছে, কগনিজেবল কেস অর্থাৎ যেগুলো ধর্তব্য অপরাধ সেখানে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার করতে পারে। সেটা তো আইনে তৈরি করে দেওয়া আছে এবং এর প্রয়োজন হয়। কোর্ট থেকে তো সব সময় ওয়ারেন্ট আসা সম্ভব নয়। এখন এই ক্ষমতাটা থাকবে কি-না, সেটা আরেক বিষয়। সেটি ঠিক করবেন আইনপ্রণেতারা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন গণমাধ্যমকে বলেন, আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন সেটা সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি। আইন যেমন দরকার, তেমনি তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এ নীতিমালা কার্যকরের জন্য পুলিশ বাহিনীকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। তবে এটা ঠিক, এই নীতিমালার আলোকে ভুক্তভোগীদের সাহায্যে মানবাধিকার কর্মীরা আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের পরিচালক ও আইন উপদেষ্টা স ম রেজাউল করিম বলেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবাইকে এই রায় মানতে হবে। এই রায়ের ফলে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না পুলিশ। পুলিশের হেফাজতে মানুষের মৃত্যুও কাম্য নয়। পুলিশের মধ্যে ভালো লোক আছেন। তারা রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ, সে বিষয়টির দিকে নজর রাখতে হবে। নির্মমভাবে নয়, আসামিদের প্রতি মানবিক দিকটাও বিবেচনায় আনতে হবে। পুলিশ এ দেশেরই মানুষ। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা জনসেবায় নিয়োজিত। এ সব বিষয়ের ওপর পুলিশের নতুনভাবে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই রায় সাধারণ মানুষের পক্ষে বড় ধরনের কাজ করবে। ফৌজদারি এ ধারাগুলো ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে অবৈধভাবে প্রয়োগ করা হতো। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও প্রশাসন বলে কিছু থাকত না।
পুলিশের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপিল বিভাগের এ নীতিমালা তারা আপাতত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে এটি বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে ওই ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে অবহিত করতে হবে। নিকটাত্মীয় না থাকলে গ্রেফতার ব্যক্তির পরামর্শে তার বন্ধুকে জানাতে হবে। এ কাজে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় দেরি করা যাবে না। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যকর কোনো মামলার আসামি অথবা সংঘবদ্ধ অপরাধ করেছে এমন মামলা, এমনকি পরিবারের অনেকে একই ঘটনায় জড়িত এমন কেসে গ্রেফতার ব্যক্তির স্বজনকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে তথ্য জানালে অন্যরা পালিয়ে যেতে পারে। ন্যয়বিচার নিশ্চিতে অনেক ক্ষেত্রে এটা ‘অসুবিধাজনক’ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর তাৎক্ষণিকভাবে মেমোরেন্ডাম বা স্মারক তৈরি করবে। গ্রেফতার ব্যক্তির স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন ওই কর্মকর্তা। যেখানে তারিখ ও গ্রেফতারের সময় থাকবে। বর্তমানে গ্রেফতারের পর কোনো স্বাক্ষর রাখে না পুলিশ। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পরপরই স্বাক্ষর রাখার নীতিমালাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা। গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে আসামির স্বাক্ষর রাখার বিষয়টি মামলা পরিচালনা ব্যবস্থাপনায় নতুন সংযোজন।
পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, এ নীতিমালার মূল শিক্ষণীয় দিক হলো মানবাধিকার ও আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রয়োগ। নীতিমালায় বলা আছে, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারায় উদ্দেশ্য পূরণে কোনো ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে না।
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত মে মাসে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার ব্যাপারে আপিল বিভাগের রায়ের পর থেকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার সারাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। আদালত ৫৪ ধারা বাতিল করেননি। ৫৪ ধারায় আটকাদেশ বাতিল করেছেন। তবে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ৫৪ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার কথা বলা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের ৪৯ থানায় কয়েক মাসে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার হয়েছে গুটিকয়েক ব্যক্তি। হলি আর্টিসানে হামলার ঘটনায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম ও ব্যবসায়ীপুত্র তাহমিদ হাসিব খানকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। পরে হাসনাত করিমকে হলি আর্টিসানের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
আপিল বিভাগের নীতিমালায় বলা হয়েছে, গ্রেফতারের পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন সুনির্দিষ্ট মনে করছেন তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উল্লেখ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কেস ডায়েরিও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করবে পুলিশ। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে কোনো ব্যক্তিকে রিমান্ড চাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ আদালতের কাছে রিমান্ড আবেদনের প্রয়োজনীয় কথা তুলে আবেদনপত্র লেখে। কেস ডায়েরি উপস্থাপন করে না। কেস ডায়েরিতে মূলত ওই ঘটনায় আসামির ব্যাপারে কী তথ্য পাওয়া গেছে তার সর্বশেষ বর্ণনা থাকে। আদালতের কাছে কেস ডায়েরি উপস্থাপন করা হলে দেখা যাবে, পুলিশ এরই মধ্যে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে তদন্তে কী কী তথ্য পেল।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নতুন নীতিমালায় গ্রেফতারের কারণ স্পষ্ট ও লিখিতভাবে আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এটা মানার ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকবে। কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হলে ভুক্তভোগী পরিবার আদালতের আশ্রয় নিতে পারবে। সূত্র: সমকাল
Discussion about this post