জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার পর ঘর ছেড়েছে আরও দুই তরুণ। মিরপুরের মণিপুর এলাকার এই দুই তরুণও ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে। তারা হচ্ছে আহমেদ রাফিদ আল হাসান (১৮) ও আয়াদ হাসান (১৮)। সম্প্রতি এ লেভেল পাশ করা এই দুই তরুণ সম্পর্কে আপন খালাতো ভাই। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা ও কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের বড় ঘটনাগুলোর পর দেশজুড়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির মধ্যেও গত ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় এই দুই তরুণ একসঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।এরপর থেকে তাদের আর খোঁজ পাচ্ছে না তাদের পরিবার।
এ ঘটনায় আয়াদ হাসানের মা মুনমুন আহমেদ রাজধানীর মিরপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। জিডি নং ৬৩৭। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ এই দুই তরুণের আগের কার্যক্রম ও চলাফেরা বিশ্লেষণ করে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। একই সঙ্গে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। তাদের পরিবার জানিয়েছে, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তারা তাদের পাসপোর্টও সঙ্গে নিয়ে গেছে। এ কারণে তারা দেশেই আছে নাকি দেশের বাইরে চলে গেছে এ ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন তাদের পরিবার।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার আলমগীর হোসেন জানান, দুই তরুণ নিখোঁজের বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তারা ঠিক কী উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে তিনি মনে করেন, বৈধপথে তারা দেশ ছেড়ে যায়নি। তিনি বলেন, ‘ইমিগ্রেশন পয়েন্টে খোঁজ নিয়ে দেখা হয়েছে। তারা দেশ ছেড়ে যায়নি। দেশ যেন ছাড়তে না পারে সেই ব্যবস্থাও নিয়ে রাখা হয়েছে।’
পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মিরপুরের মণিপুরের ১২৭০ নম্বর বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতো আহমেদ রাফিদ আল হাসান। তার বাবার নাম প্রকৌশলী তৌফিক হাসান। মায়ের নাম নিলুফা ইয়াসমিন শিল্পী। গ্রামের বাড়ি কেরাণীগঞ্জের কলাতিয়া এলাকায়। আর আয়াদ হাসানের বাবার নাম মৃত আলী হাসান। মায়ের নাম মুনমুন আহমেদ। পরিবারের সঙ্গে সে পূর্ব মণিপুরের ১৩০৭/২ নম্বর বাসার পঞ্চম তলায় থাকতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ আয়াদ হাসান বাবা-মায়ের সঙ্গে সৌদি আরবে থাকতো। সৌদি আরবের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তো সে। বাবা মারা যাওয়ার পর সে ঢাকায় প্রাইভেটে এ লেভেল পরীক্ষা দেয়। সম্প্রতি এর ফলাফলও প্রকাশিত হয়েছে। অপরদিকে আহমেদ রাফিদ আল হাসানও ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে এ লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে।
নিখোঁজ রাফিদ আল হাসানের মা ইয়াসমিন রহমান শিল্পী বলেন, ‘আমার ছেলেটা কেমনে এই পথে গেলো আমি বুঝতে পারছি না। কেউ তাকে ব্রেনওয়াশ করেছে। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাওয়ার পাশপাশি যারা তাকে ব্রেনওয়াশ করেছে তাদেরও বিচার চাই।’ ইয়াসমিন রহমান শিল্পী বলেন, ‘ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই নামাজ-কালাম পড়তো। কিন্তু কখনও অস্বাভাবিক আচরণ দেখি নাই। কোনও কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করতো না। কিন্তু সম্প্রতি ওর আচরণ একটু চেঞ্জ হয়েছিল।ও চলে যাওয়ার পর আমি তা বুঝতে পেরেছি।’
আয়াদ হাসানের মা মুনমুন আহমেদ বলেন, ‘আমার ছেলে নিখোঁজ হয়েছে। আমি খুব ডিস্টার্ব আছি। ছেলেটার সৌদি আরবে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ও নামাজ-কালাম পড়তো। হঠাৎ সে কেন বাসা ছেড়ে চলে গেলো বুঝতে পারছি না।’ মুনমুন আহমেদ বলেন, ‘ছেলেটা কারও পাল্লায় পড়ে হয়তো এই লাইনে যেতে পারে। আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
সম্প্রতি জঙ্গি হামলা ও পুলিশের অভিযানে একাধিক তরুণ নিহত হয়েছে, যাদের অনেকেই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ও ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র ছিল। এদের বেশিরভাগই তিন থেকে এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিল। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিখোঁজ তালিকাতেও ধনাঢ্য পরিবারের ও ইংরেজি মাধ্যমের একাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। সর্বশেষ নিখোঁজের তালিকায় যোগ হলো এই দুই তরুণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আয়াদ হাসান ও রাফিদ আল হাসানের আরেক মামাতো ভাই আরেফিন ইসলামের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়। আরেফিন ইসলাম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের ৮ম সেমিস্টারের ছাত্র। কিন্তু সম্প্রতি সে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ার কারণে সেখানে আর পড়বে না বলে বাসায় ঘোষণা দিয়েছে। সূত্র জানায়, আরেফিনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর আয়াদ ও রাফিদ দুজনই আরেফিনের সঙ্গে চলাফেরা করতো।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা ইতোমধ্যে আরেফিন ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তারা নিশ্চিত হয়েছেন আরেফিনের মাধ্যমেই এই দুই তরুণ জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়।
দুই খালাতো ভাইয়ের নিখোঁজ পরবর্তী গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক মাস আগে হঠাৎ করেই আয়াদ ও রাফিদের আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেয়। তারা পরিবারের মহিলা সদস্যদের হিজাব ও নামাজ পড়তে বলে। তারা বাসায় ইন্টারনেটে ধর্মীয় বিষয় সংক্রান্ত সাইট নিয়ে পড়ে থাকতো। নিখোঁজ দুই পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আরেফিনের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি পরিবারের সবাই জানতো। আয়াদ ও রাফিদকে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত না করার জন্য বেশ কয়েকবার সতর্কও করা হয়েছিলো। কিন্তু তারা গোপনে যোগাযোগ করে ইন্টারনেট ও মিরপুর-১০ নম্বরের একটি ফলের দোকানে গিয়ে নিয়মিত গোপন বৈঠক করতো।
গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন, আরেফিন ইসলাম, আহমেদ রাফিদ আল হাসান ও আয়াদ হাসান মিলে ‘বুক অব ড্রিমস’সহ নানা রকম জিহাদি বই পড়তো। এছাড়া আত তামাকিন ও ব্লগস্পটের নানারকম ইসলামি ব্লগে নিয়মিত ব্রাউজ করতো।
‘আমরা আমাদের পথ খুঁজে পেয়েছি’
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নিখোঁজ আহমেদ রাফিদ আল হাসান বাসা থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে একটা চিরকূট লিখে রেখে যায়। ওই চিরকূটে লেখা ছিল ‘আমরা আমাদের পথ খুঁজে পেয়েছি।’ বিষয়টি পুলিশের কাছেও জানানো হয়েছে। এছাড়া স্বজনরা বলছেন, নিখোঁজ হওয়ার আগে রাফিদ ও আয়াদ এক ‘বড় ভাই’-এর সঙ্গে কথা বলতে বাইরে যায় বলে বাসায় আলোচনা করতো। রাফিদের মা নিলুফার ইয়াসমিন জানান, তিনি তার ছেলেও বোনের ছেলেকে এক ‘বড় ভাই’ বিষয়ে কথা বলতে শুনেছেন। কিন্তু ওই ‘বড় ভাই’টা কে তা জিজ্ঞাসা করলে তারা স্পষ্ট করে তাকে কিছুই বলেনি। আর বিষয়টি যে এত মারাত্মক হতে পারে তা মা হিসেবে তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।নিলুফার ইয়াসমিনের আশঙ্কা, কথিত ওই ‘বড় ভাই’-ই তার ছেলে ও বোনের ছেলেকে জঙ্গিবাদের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। তিনি তাদের নিখোঁজ দুই ছেলের পাশাপাশি ওই ‘বড় ভাই’কেও খুঁজে বের করার জোর দাবি জানিয়েছেন পুলিশের কাছে।
স্বজন সূত্রে জানা গেছে, রাফিদ বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আনুমানিক এক লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছে।এছাড়া নিখোঁজ হওয়ার আগে তারা নিজেদের পাসপোর্টও সঙ্গে নিয়ে গেছে। রাফিদের পাসপোর্ট নম্বর এএ ৫৮৬৫৮১৫ এবং আয়াদের পাসপোর্ট নম্বর এএ ৬২৫২৬২১।
রাফিদের বাবা জামায়াতের রুকন!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিখোঁজ আহমেদ রাফিদ আল হাসানের বাবা প্রকৌশলী তৌফিক হাসান জামায়াতের একজন রুকন। তিনি তার শ্বশুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ট্রেডিং সিন্ডিকেট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এই প্রতিষ্ঠানটি দামি মেডিক্যাল ইক্যুপমেন্ট আমদানি করে থাকে। প্রকৌশলী তৌফিক হাসান গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় কেরাণীগঞ্জের একটি ইউনিয়ন থেকে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করে হেরে যান। বছর তিনেক আগে তিনি একটি মামলায় জেলও খেটেছেন। তার বিরুদ্ধে জামায়াতকে অর্থ সহযোগিতা করারও অভিযোগ রয়েছে। ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর তিনি আমেরিকায় চলে যান বলে জানা গেছে। তবে তৌফিক হাসানের স্ত্রী নিলুফার ইয়াসমীন দাবি করেছেন, ‘তৌফিক অনেক আগে জামায়াতকে সমর্থন করতো। এখন সে কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়।’ কেরাণীগঞ্জের ইউপি নির্বাচনে তিনি (তৌফিক) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরেছিলেন বলেও জানান তার স্ত্রী নিলুফার।
Discussion about this post