বিদ্যমান জনবল কাঠামো ব্যবহার করেও মামলাজট অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব; কিন্তু বাস্তবে তেমন হচ্ছে না। অনেক জেলায় বিচারক সংশ্লিষ্ট সহায়ক জনবল সংকটে, বিভিন্ন পদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অজ্ঞতার কারণেও বিচারকাজে কাঙ্ক্ষিত গতি আসছে না। এ ছাড়া মামলা অনুপাতে নিয়মিত উচ্চ ও অধস্তন আদালতে নতুন বিচারক এবং সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ না হওয়ায় মামলার সংখ্যা ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। মামলাজট নিরসন ও আদালত ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বিচারকদের উন্নত প্রশিক্ষণে উদ্যোগী হয়েছে। অধস্তন আদালতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক-তৃতীয়াংশ বিচারককে বিদেশে প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামী মার্চ থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে ৫৪০ জন বিচারককে পর্যায়ক্রমে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠানো হবে।
আইন ও বিচার বিভাগের কার্যপরিধি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলা জজ বা সমপর্যায়ের পদ সৃষ্টি করে বিচারক নিয়োগ দিলেও তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে অথবা তাদের অভিজ্ঞতা সীমিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলার জন্য একটি করে জেলা জজ আদালত রয়েছে। এগুলোতে কর্মরত জেলা জজ বা সমপর্যায়ের বিচারক ১৮৭ জন। কিন্তু তাদের মধ্যে শুধু ঢাকাতেই কাজ করছেন ৬১ জেলা জজ বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা, যা মোট জেলা জজের এক-তৃতীয়াংশ। অথচ এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও দেশের চারটি জেলায় প্রধান জেলা জজের পদ শূন্য রয়েছে। এগুলো হলো ফরিদপুর, রাজবাড়ী, পাবনা ও বগুড়া। এ ছাড়া সারাদেশে জেলা জজ ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মোট পদ শূন্য রয়েছে ৪২টি। এর বাইরেও অধস্তন আদালতের বিচারসংশ্লিষ্ট সহায়ক প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ পদ শূন্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রেষণে ঢাকায় শতাধিক বিচারক: দেশের অধস্তন আদালতে অনুমোদিত বিচারকের পদ রয়েছে এক হাজার ৬৫৫টি। এর মধ্যে শূন্য পদের সংখ্যা ৪০৮টি। অধস্তন আদালতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ বিচারকের পদ শূন্য থাকলেও প্রেষণে ঢাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ১০৩ জন বিচারক কর্মরত রয়েছেন। তাদের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে ৪৫ জন, সুপ্রিম কোর্টে ২০ ও আইন কমিশনে আটজন কাজ করছেন। এ ছাড়া জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় আরও ২৩ জন বিচারক রয়েছেন, তবে তাদের পদায়ন প্রেষণে হয়নি।
স্থায়ী বিচার প্রশাসন: ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হওয়ার পর স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়ে। তখন প্রেষণে বিচারক দিয়ে বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। তবে এই বিচারকরা প্রশাসনিক পদগুলোতে স্থায়ী নন। তারা পদোন্নতিসহ বিভিন্ন কারণে প্রশাসনিক পদ ছেড়ে আবারও বিচারকাজে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে বিচার বিভাগে নিজস্ব কোনো ক্যাডার সার্ভিস তৈরি হচ্ছে না। তাই বিচার বিভাগ পৃথক্করণ-সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে, যা গত আট বছরেও সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া পায়নি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
তবে পৃথক সচিবালয় হলেও বিচার বিভাগের জন্য স্থায়ী ক্যাডার সার্ভিস তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক ক্যাডার না থাকায় ২০০৭ সাল থেকে প্রেষণে বিচারকদের পদায়ন করে প্রশাসনিক কাঠামো সামলানো হচ্ছে। কিন্তু এভাবে অনন্তকাল চলার কথা নয়।’ তিনি বলেন, ‘কিছু বিচারক ঢাকায় থাকার জন্য প্রেষণের পদগুলো বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তারা বিচারিক পদগুলোতে থাকলে মামলাজট আরও অনেক কমে আসত।’ তিনি আরও বলেন, ‘পৃথক সচিবালয় হোক বা না হোক, বিচার বিভাগের নিজস্ব স্থায়ী প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিস প্রয়োজন। আর পৃথক সচিবালয় হলেও তখন এই ক্যাডার সার্ভিসের জনবল কাঠামো ব্যবহার করা যাবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) মাধ্যমে শুধু বিচারক নিয়োগ না দিয়ে অবিলম্বে বিচার বিভাগের জন্য নিজস্ব প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিস তৈরি করতে হবে। এটা হলে বিচার প্রশাসনের দক্ষতা আরও বাড়বে এবং বিচারকদের প্রেষণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পদায়নেরও প্রয়োজন হবে না।
অবশ্য বিচার প্রশাসনের দক্ষ ক্যাডার সার্ভিস তৈরির জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের পাশাপাশি ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর আদলে ‘জাতীয় জুডিসিয়াল একাডেমি’ গড়ে তোলার জন্য সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। গত বছরের ২২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো প্রস্তাবে জুডিসিয়াল একাডেমি গড়ে তোলার জন্য সাভার, কেরানীগঞ্জ বা গাজীপুরে ২৫ একর জমি বরাদ্দ দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে আইন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
পৃথক সচিবালয় গঠন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার কোনো ক্ষমতা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘রুলস অব বিজনেস, অ্যালোকেশন অব বিজনেস ও সংবিধান থেকে দেখা যাবে, আইন মন্ত্রণালয় কোনো সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম করে দিতে পারে না।’
জনবল সংকট: বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে থাকা শতাধিক বিচারকসহ এ মুহূর্তে আদালতে বিচারকের ৪০৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে জেলা জজের ৩৮টি, অতিরিক্ত জেলা জজের ৯টি, যুগ্ম জেলা জজের পদ ১৭টি, সিনিয়র সহকারী জজ ও সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ১৯৬টি এবং সহকারী জজ ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ১৪৮টি পদ। এর ফলে গরিব মানুষের বিনামূল্যে আইনসেবা পাওয়ার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার ৬৪টির মধ্যে ৪১টি এবং নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের ৫৪টির মধ্যে ১৯টি পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া ৬৪ জেলা অধস্তন আদালতে বিচারসংশ্লিষ্ট সহায়ক পদ শূন্য থাকলেও তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, আদালতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বর্তমান প্রধান বিচারপতির দুই বছরে বিভিন্ন সময় দুই হাজার ৪৬৮টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে রিসার্চ ইউনিটের জন্য ২৪টি, বিচারপতিদের জন্য ১০০ গার্ড ও বাবুর্চি, হাইকোর্টের জন্য চতুর্থ শ্রেণির ১৬০টি এবং প্রিন্টিং প্রেসের জন্য ৩৯টি পদ সৃজনের প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য। আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিধি অনুসারে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা এখনও বিবেচনাধীন। অবশ্য একটি চিঠির আলোকে গত বছরের ১ জুন শুধু সুপ্রিম কোর্টে রেজিস্ট্রার জেনারেলসহ নয়টি নতুন পদ সৃজন করা হয়েছে।
মামলাজট নিরসনে দৃষ্টান্ত: মামলাজট নিরসনের কৌশল নির্ধারণে সরকার ও বিচার বিভাগ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন এক বছরে সোয়া দুই লাখ মামলা নিষ্পত্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট থেকে গত বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত এসব মামলা নিষ্পত্তি হয় বলে জানা গেছে। উল্লিখিত সময়ে নতুন মামলা হয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৯৯৪টি। সব মিলিয়ে এক বছরে সিএমএম আদালতে মামলাজট কমেছে প্রায় এক লাখ। ঢাকার সিএমএম শেখ হাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলাজট নিরসনে একই ধরনের পুরনো মামলা চিহ্নিত করে তা নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর সুফল পাওয়া গেছে। আশা করছি, এ ধারা অব্যাহত থাকবে।’
২০১৫ সালের ৬ আগস্ট সিএমএম আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল তিন লাখ তিন হাজার ৪১৮টি। এর মধ্যে মোটরযান অধ্যাদেশের অধীনে মামলা ছিল এক লাখ ৫৪ হাজার ১৬০টি। আসামিদের অনুপস্থিতিতে এবং মামলা দায়েরের বিভিন্ন ত্রুটির কারণে এসব মামলা নিষ্পন্ন হচ্ছিল না। তবে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে মামলাসংশ্লিষ্ট ‘প্রসিকিউশন রিপোর্ট’-এর আলোকে উল্লিখিত সময়ে মোটরযান আইনের এক লাখ ২২ হাজার ২৮টি মামলা এবং ফৌজাদারি কার্যবিধি, দ্রুত বিচার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ-সংক্রান্ত আইনের আওতায় ৯৩ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুসারে, ২০১৪ সালে পাইলট প্রকল্পের আওতায় সোয়া লাখ মামলা নিষ্পত্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের দুটি জেলা আদালত।
সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ: অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে গৃহীত এ প্রকল্পের নাম ‘অধস্তন আদালত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণে আইন ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’; ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় ৫৪০ বিচারক বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্স করার সুযোগ পাবেন। এ জন্য অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি হয়েছে।
এদিকে, এক-তৃতীয়াংশ বিচারক প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে থাকলে আগামী দিনগুলোতে মামলাজট আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ জন্য অধস্তন আদালতে দ্রুত প্রয়োজনীয় বিচারক নিয়োগ দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘প্রয়োজন অনুসারে শিগগিরই অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হওয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করার জন্য যা যা করণীয় তা-ই করছে। এটা চলমান থাকবে।’
আবু সালেহ রনি/সমকাল
Discussion about this post