মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তানুযায়ী বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেয়ার বিধান কার্যকর হলে দেশের বিচার বিভাগ ও সংবিধানের অপূরণীয় ক্ষতি হবে বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান প্রণেতা ও সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন।
বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নব নিবার্চিত কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতির বক্তব্য তিনি এ মন্তব্য করেন।
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তানুযায়ী বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেয়ার বিধান কার্যকর হলে দেশের বিচার বিভাগ ও সংবিধানের অপুরণীয় ক্ষতি হবে। এক মিনিটেই কেবিনেটে আইন পাস করলে হবে না। এটি যদি জনমত উপেক্ষা করে করা হয়, তবে তার ফল ভালো হবেনা।’
উল্লেখ্য, গত ২৫ এপ্রিল (সোমবার) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত ও প্রমাণ) আইন ২০১৬ খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আইনটি পাস হলে বিচারকদের অপসারণে ক্ষমতা পাবে জাতীয় সংসদ।
তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ এ তিনটির একটিতেও না বুঝে হাত দিলে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে। বিচার বিভাগে হাত দেয়া মানে সংবিধানের উপর হাত দেয়া, স্বাধীনতার উপর হাত দেয়া, দেশের স্থিতিশীলতার উপর হাত দেয়া।’
ড. কামাল হোসেন আরো বলেন, ‘বিচার বিভাগ তখনই স্বাধীন হবে। যখন বিচারকরা মনে করবেন রায় সরকারের বিপক্ষে গেলেও আপিলের পরিবর্তে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার ভয়টি দূর হবে। ১৬তম সংবিধান সংশোধননীতে বিচারকদের অপসারণের সুযোগ রেখে আইন প্রণয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। সেই সুযোগে সম্প্রতি মন্ত্রীসভার বৈঠকে এই আইনটির খসড়া পাস হয়েছে।’
সিনিয়র এ আইনজীবী বলেন, ‘বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সরকার সেটি মন্ত্রীসভায় কেন তাড়াহুড়ো করে পাস করে ফেলতে চাচ্ছে সেটির জবাব দিতে হবে। আগামী ৫ মে মামলাটির রায় প্রদান করা হবে। এই মামলায় আদালতের আমন্ত্রণে আমি লিখিত মতামত দিয়েছি। এই আইনটিতে অবশ্যই বিচারকদের মতামত নিতে হবে।’
ড. কামাল বলেন, ‘খসড়া আইনের উপর বিচারকদের মতামত নেন, জজ সাহেব, বিশ্লেষক, সাবেক প্রধান বিচারপতি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিনদের মতামত নিন। এই সংশোধনীর উপর মতামত না নিলে, আলোচনা না করে সেটি পাস করলে বিচার বিভাগের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।’
বিশিষ্ট এ সংবিধান প্রনেতা বলেন, ‘সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে কেউ পার পায়নি, এখনো পাবেনা। সবাই সব দল করতে পারেন। তবে সংবিধান, গণতন্ত্র আর মৌলিক অধিকার ভূলন্ঠিত করে পার পাওয়া যাবেনা। অতীতেও আমরা সামরিক শাসকদের প্রতিরোধ করেছি, সংবিধান রক্ষা করেছি। আপনারা যে দলেরই হোন না কেন? সংবিধান নিয়ে এত কথা কেন? সংবিধানের এত ব্যাখা কেন? আসুন আমরা এই সংবিধানকে রক্ষা করতে আইনজীবীরা একসাথে বসি। সংবিধানের মৌলিক অধিকার নিয়ে, অক্ষুন্নতা নিয়ে এবং সংবিধান রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করা দরকার।’
সরকারকে হুশিয়ারি দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তান সরকারকে যেমন আমরা পরাজিত করেছি। তেমনি সংবিধানকে অমান্য করে পাশ কাটিয়ে যারা দেশ চালাতে চায় তাহলে তারা মনে হয় ভুল করছে। সরকার তো নির্বাচিত নয়, এরপরও তারা নিজেদের নির্বাচিত দাবি করেও কলমের খোঁচায় জনগণকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করতে পারেনা। এই সংবিধানকে আমরা অর্জন করেছি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে।’
স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতিসৌধে যাবার পাশাপাশি জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত স্বাধীনতার দলিল ও সংবিধান দর্শন করে আসা উচিত বলেও মন্তব্য করেন সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘সরকার বিচারক অপসারণে যে আইনের খসড়া মন্ত্রীসভায় পাস করেছে সেটি বিচার বিভাগের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ। এই আইনের ফলে বিচারকরা সব সময় আতঙ্কে থাকবেন। ক্ষতিগ্রস্থ হবেন প্রকৃত বিচার প্রার্থীরা। এই আইন প্রণয়ন না করে যোগ্য বিচারক নিয়োগে আইন করা দরকার।’
বার কাউন্সিলের এ সদস্য বলেন, ‘বিচারক অপসারণের আগে বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করুন। বিচারকদের মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ না দিয়ে বিচার বিভাগ থেকে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে অাগে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার বিচারক অপসারণের যে আইন করছে, সেটিতে তিন সদস্যের কমিটির শুনানিতেই বিচারককে অপসারণ করার সুযোগ রয়েছে। কমিটির দুজন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও অ্যর্টনি জেনারেল, আরেকজন মান্যগণ্য ব্যক্তি। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে এটি সরকারের অাজ্ঞাবহ কমিটি। তাহলেতো যে কোন অভিযোগেই বিচারককে অপসারণ সহজে করা সম্ভব হবে। এই সরকারের ধারাবাহিকতায় আগামীতে যে সরকার আসবে সেই সরকারও সেই পথে চলবে। যেটি বিচার বিভাগের জন্য ক্ষতিকর।’
এসময় সকল অাইনজীবীদের দলমত নির্বিশেষে এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অাহ্বান জানিয়েছেন ড. কামাল হোসেন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. কফিল উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশেষ অথিতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য এড.ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শাহে নুর, ভারপ্রাপ্ত জেলা দায়রা জজ সিরাজদৌল্লাহ কুতুবী ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহজাহান কবির প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহেদ বীরু।
Discussion about this post