
ড. বদরুল হাসান কচি
সাধারণভাবে আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদী পরিবর্তন যা প্রাকৃতিকভাবে ঘটে তাকে বোঝায়। মানুষসৃষ্ট দূষণের কারণে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সূর্য থেকে আগত শক্তি মোটামুটি অপরিবর্তিতভাবে স্বচছ বায়ুমন্ডলকে ভালভাবে ভেদ করে এবং ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগকে উত্তপ্ত করে। বায়ুমন্ডলের কিছু গ্যাস ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ থেকে আগত নিম্ন শক্তির তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অংশবিশেষকে ধরে রাখে এবং এর কিছু অংশ নিচের দিকে পুনরায় বিকিরিত হতে থাকে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ এবং বায়ুমন্ডলের নিচের অংশ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। একেই গ্রীণহাউজ প্রতিক্রিয়া বলে।
শিল্পকারখানা থেকে নিঃসরিত সালফেট কণা সৌর বিকিরণকে প্রতিফলিত করে এবং এর ফলে এটি জলবায়ুকে শীতল রাখতে ভূমিকা রাখে । এই কণিকা ১৯৪০ থেকে বেশ কিছু দশক পর্যন্ত উষ্ণতাকে আড়াল করে রাখতে সাহায্য করতো, কিন্তু এই বিষাক্ত পদার্থগুলোর কমে যাওয়ায় এবং সেই সাথে গ্রীণহাউজ গ্যাসের নিয়মিত ঘনত্ব বৃদ্ধিতে ১৯৭০ সাল থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নতুন করে বাড়িয়ে তোলে। বৈশ্বিক জলবায়ু উষ্ণায়নের সাথে সাথে জলবায়ু সংক্রান্ত চরম ঘটনাবলী যেমন তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা মানুষের কর্মকান্ড যেমন: জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর দরুণ একই রকম দূযোর্গের ঝুঁকি দ্বিগুন হয়েছে। কিছু অঞ্চলে খরা এবং বন্যা বেড়েছে। কিছু অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিবহুল দিনের সংখ্যা বেড়েছে। বছর বছর গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় এবং হ্যারিকানের মাত্রা ভিন্ন হয়, কিন্তু প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে ১৯৭০ সাল থেকে এর তীব্রতা এবং স্থায়ীত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
বর্তমানে উন্নত দেশগুলো গত দুইশ’ বছর ধরে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করেছে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে যে পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, যে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন উৎপন্ন হয়েছে, সেটা বায়ুমণ্ডলে আটকে আছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতো দেশগুলোর দুইশ’ বছরের দাহনের ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের বায়ুমণ্ডল অনেক বড়, কিন্তু বর্তমানে এর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত দেশগুলোর একটি, বাংলাদেশ। জাতিসংঘের হিসাব মতে, যদি জলবায়ুর উষ্ণতা এই গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে সমুদ্র ও নদীর স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় ১ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হবে, আর বাংলাদেশ হারাবে তার মোট স্থল ভাগের প্রায় ১০ শতাংশ। এদেশের উর্বর ভূমি বিরান হয়ে যাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে। শীতকালে খড়া ও বর্ষাকালে ক্রমবর্ধমান বন্যায় এই দেশ বিপর্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা ও সাইক্লোনের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মতো দাড়াবে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে বিবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেমন-
অস্বাভাবিক তাপমাত্রা
বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ সেই পরিচিতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি
বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়।
সুপেয় পানির অভাব
২০০৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরির্বতন-সংক্রান্ত প্যানেলের (IPCC) পানিসম্পদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ সমুদ্রতীরের বেশ কটি দেশে সামনের দিনে মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। ২০২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এ সমস্যা ভয়াবহ রূপ নেবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ায় অনেক এলাকায় দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির অভাব। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এই অভাব প্রকট।
অতিবৃষ্টি ও তীব্র বন্যা
বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০৯৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং প্রতি বছরই প্রায় ১৫ লক্ষ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে থাকে।
নদীভাঙন
বাংলাদেশে, সাধারণত বর্ষাকালে উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুন নদীর পানি বেড়ে যায় এবং তা প্রচন্ড গতিতে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। এসময় উপকূলীয় অঞ্চলের নদীসংলগ্ন স্থলভাগে পানির তীব্র তোড়ে সৃষ্টি হয় নদীভাঙনের। বাংলাদেশে এটা স্বাভাবিক চিত্র হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় তা আর স্বাভাবিক বলে পরিগণিত হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যমতে, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছে।
ভবিষ্যৎ শংকা সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি
বঙ্গোপসাগরের সাথে দেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগ থাকায় দিনে দিনে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ডুবে যাবার আশংকায় রয়েছে বাংলাদেশ। UNFCCC’র দেয়া তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরো ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়লে মালদ্বীপসহ তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী দেশ বাংলাদেশও। জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল-এর তথ্যমতে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অন্তত ১৭% ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে । আর তাতে বিনষ্ট হবে ১৩ ভাগ কৃষি জমি।
জীবিকার উৎস ধ্বংস
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশনির্ভর উপজীবিরা তাদের জীবিকা হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়বে। এতে দেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। যেমন মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্বাদু পানির মৎসজীবি, সমুদ্রগামী জেলে, উপকূলীয় জেলে ও তাদের পরিবারগুলো জীবিকার উৎস হারাবে। এরকম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারেরই এক লক্ষ জেলে।
জলবায়ু উদ্বাস্তু
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সংবাদ মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১-১.৫ কোটি মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বিপুল সংখ্যক (প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ) মানুষ ছেড়েছে খুলনার কয়রা এলাকা; পাড়ি জমিয়েছে ঢাকা, রাঙ্গামাটি কিংবা খুলনা সদরে। ভোলাতে রাজাপুর ইউনিয়নের তথ্যমতে ২০০৯ সালে ৬৫০টি পরিবার ঘর-জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। হঠাৎ বন্যায় লোকালয়ে লোনাপানি ঢুকে যাবার কারণে ২০০৮ সালে সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৪২,০০০ মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এসকল উদ্বাস্তুর কারণে বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে রাজধানী শহর ঢাকায়।
এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ কি
‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন, ২০১০’ প্রণয়ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে এবং সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় এই ট্রাষ্টের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আইনে ট্রাস্টের লক্ষ্যে বলা হয়েছে- (ক) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের জনসাধারণের বা জনগোষ্ঠীর খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা; (খ) জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মানুষ, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থের ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা করার পক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কৌশল কি হতে পারে
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্যে আমাদের আর্থ-সামাজিক রীতি নীতি ও অর্থনীতির বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা যে সব নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলছেন, তার মধ্যে আছে, কার্বন/ জ্বালানি কর, বিক্রয়যোগ্য পারমিট, কার্বন জ্বালানির উৎস থেকে সাবসিডি প্রত্যাহার, কার্বন মুক্ত উৎসের জন্য ভর্তুকি ও কর সুবিধা প্রদান, রিফান্ড ব্যবস্থা, কর্মদক্ষতার মান অর্জন বা প্রযুক্তি, জ্বালানির মিশ্রণ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা, পণ্য নিষিদ্ধকরণ, স্বেচ্ছামূলক চুক্তি, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ ইত্যাদি। এছাড়া গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার জন্য প্রণোদনা প্রদান ও পরিবেশগত প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে আসা।
লেখক: আইনজীবী ও সম্পাদক




Discussion about this post