সাঈদ চৌধুরী: গত কিছুদিন আগে আমরা এক সাথে বসেছিলাম কয়েকজন । বিভন্ন কথা আলোচনার সময় উঠে এলো স্কুলে এ্যাসেম্ব্লির কথা । জাতয়ি সঙ্গীত গাওয়া, শপথ বাক্য পড়ানোর সময় কে কতটা রোমাঞ্চিত অনুভব করতো সেটাই ছিল মূল আলোচনার বিষয় । আমার ছোটবেলা থেকেই জাতীয় সঙ্গীত শুনলে অথবা গাইতে গেলে কেন যেন বুকটা ভারী হয়ে আসে । মনে হয় আমি পুরো বাংলা মায়ের কোলে ডুবে গেছি । স্যাররা আমর এই অবস্থা দেখে একদিন লাইনের মধ্য সাড়ি থেকে সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন । এই স্মৃতি বলতে বলতেই আরেকজন বললেন আরেকটি স্মৃতি । তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শুদ্ধ ভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার স্মৃতি । পরক্ষনেই তিনি খুব আফসোস করে বললেন- “সাঈদ ভাই এখন আর স্কুলগুলোতে শুদ্ধভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর রীতিটা ওভাবে দেখা যায় না । তার কথায় ভেসে উঠছিলো খুব হতাশা । তিনি এও বলছিলেন যে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল গুলোতে রেকর্ডে বাজানো হয় জাতীয় সঙ্গীত এবং তার সাথে ঠোঁট মিলিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা । তাতেও নাকি শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি থেকে যায় । এই যেমন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় প্রচুর কথা বলাবলি করে ছেলে মেয়েরা অথবা মনোযোগ দিয়ে মেলানো হয় না জাতীয় সঙ্গীতের প্রতিটি চরণ !খুব অবাক হলাম তার কথা শুনে । আমি প্রতিদিনিই অফিসে যাওয়ার সময় কয়েকটি স্কুলের সামনে দিয়েই আসি । ভাবলাম দেখতে হবেতো আসলে এখন কি অবস্থা !
যে স্কুলের সামনে দিয়ে আসি সে স্কুলের সামনে একদিন দাঁড়ালাম । সব ছেলেমেয়েকে লাইন করে দাঁড় করানো হয়েছে । জাতীয় সঙ্গীত শুরু হল । রেকডিং এ জাতীয় সঙ্গীত বাজছে এবং সবাই চেষ্টা করছে মুখ মেলাতে । শিক্ষকরাও সবাই একসাথে দাঁড়ানো নেই । জাতীয় পতাকা তোলার ক্ষেত্রেও তেমন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখলাম না । শেষমেষ একজন এসে জাতীয় পতাকা তুলে দিল তবে সে শিক্ষক নয় !
আশেপাশের কয়েকটি কিন্টার গার্ডেনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল কয়েকটিতে নাকি জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোই হয় না অনেক সময় ।
আরেকটি স্কুলের সামনে যখন যাচ্ছিলাম তখন দেখছিলাম বেসুরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর চেষ্টা ।প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর ব্যপারে এমন অনীহা আমাকে খুব ব্যথিত করেছে । একটা স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হবে সেটা রেকডিং বাজালেও খুব আদবের সাথে নিয়ম অনুযায়ী করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এটাই স্বাভাবিক । ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শুধুমাত্র এইটুকু জ্ঞান দিলে হবে না যে জাতীয় সঙ্গীতের সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । তাদেরকে বোঝাতে হবে জাতীয় সঙ্গীত আমাদের দেশের জন্য কতটা শ্রদ্ধার আর কতটা সম্মানের । জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় ও শপথ বাক্য পাঠের সময় নিজেকে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর একেবারে উজাড় করে দিয়ে বিশ্বাসে আনতে হবে দেশপ্রেম, ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ ও চেতনায় রাখতে হবে দেশের মাটিকে ।
প্রাথমিক স্তর থেকেই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর ব্যপারে প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকদের সচেতন ভূমিকা প্রয়োজন । জামাল পুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি স্কুলের কথা শুনে একদিন অভিভুত হয়েছিলাম । সেখানে তৃতীয় শ্রেণীর বাচ্চাও হারমোনিয়াম বাঁজিয়ে গাইছিল জাতয়ি সঙ্গীত এবং তা ছিল সঠিক সুর ও তালের । প্রতিটি স্কুলের অন্তত দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের থেকে এই চর্চাটা শুরু হতে পারে । পর্যায়ক্রমে প্রতিটি ক্লাসে অন্তত দুজন শিশু থাকবে যাদেরকে ট্রেনিং দেওয়া হবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর উপর । এসেম্বলির সময় ট্রেনিং প্রাপ্ত শিশুরা জাতীয় সঙ্গীত গাইবে এবং সেটা হবে সঠিক সুর, সঠিক তালের ।
অশুদ্ধ উচ্চারণে, অমনোযোগীতায় জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে যে ভবিষ্যতের খুঁটিগুলো আমরা তৈরী করছি সেটাতে তো আমরা নির্ভরশীল হতে পারবোনা । প্রতিদিনের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো ও শপথ বাক্য পাঠ শুধু কাজের আওতায় আনা যাবেনা এই বিষয়টি হল স্বত্তার আওতায় আনতে হবে । স্বত্তার আওতায় এনে যদি শিশুদের মধ্যে জাতীয় সঙ্গীতকে ধারন করানো যায় তবে সে দেশ প্রেমিক হয়ে উঠবেই ।
এজন্য সরকারের কাছে বিনীত নিবেদন প্রতিটি স্কুলের শিশুদের জন্য উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় সঙ্গীতের উপর প্রশিক্ষনের আয়োজন করানোর ব্যপারে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যপারে মনোযোগ দিন । প্রশিক্ষনের পর প্রতিযোগীতার আয়োজনও হতে পারে । তবে শিশুদের মধ্যে এ বিষয়ে স্পৃহা বাড়বে এবং একই সময়ে সারা বাংলাদেশে স্কুলে স্কুলে নিজেদের কন্ঠে শুদ্ধ উচ্চারণে বেজে উঠবে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…” ।
Discussion about this post