ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি রয়েছেন দুর্বৃত্তের হামলার শিকার অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বর্তমানে তিনি শঙ্কামুক্ত আছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। রবিবার সকাল ১১টায় তার ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
এর আগে শনিবার বিকালে হামলার পরপরই সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে অস্ত্রোপচার করা হয় তার। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তার উপস্থিতিতেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জাফর ইকবালের হাতে ও পিঠে ২৬টি সেলাই করা হয়।
শনিবার বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান চলাকালে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে পেছন থেকে মাথায় ছুরিকাঘাত করে ফয়জুর রহমান ফয়জুল (২৫) নামের এক তরুণ। এরপর জাফর ইকবালকে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ছাত্ররা ফয়জুল নামের ওই হামলাকারীকে মারধরের পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পরে র্যাবের হেফাজতে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ
ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই হেলিকপ্টারে করে তাকে ঢাকায় আনা হয়। রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি শঙ্কামুক্ত। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান রাতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
আইএসপিআর জানায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রবিবার (৪ মার্চ) সকাল ১১টায় জাফর ইকবালের শারিরীক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে।
কে এই হামলাকারী
হামলাকারীর নাম ফয়জুর রহমান ফয়জুল (২৫)। বর্তমানে সে র্যাবের হাতে আটক রয়েছে। ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব ফয়জুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে টুকেরবাজার এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতো সে। তার বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ফয়জুলদের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। বছর দুয়েক আগে তার বাবা টুকেরবাজার এলাকায় জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন। ফয়জুলরা তিন ভাই, সে সবার ছোট। অন্য দুভাইয়ের নাম আবুল ও হাসান। প্রতিবেশীরা জানিয়েছে, এই পরিবারটি স্থানীয়দের সঙ্গে মেলামেশা করতো না। এমনকী ফয়জুল স্থানীয় মসজিদে নামাজও পড়তো না। তার লেখাপড়ার বিষয়েও প্রতিবেশীরা কিছুই জানাতে পারেনি। এদিকে, জাফর ইকবালের ওপরে হামলার পর ফয়জুলের পরিবারের সদস্যরা ঘরে তালা মেরে পালিয়ে গেছে।
সিলেটের জালালাবাদ উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নের শেখেরপাড়া ওয়ার্ডের সদস্য গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘ফয়জুলের বাবার নাম মাওলানা আতিকুর রহমান। তারা এই এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছে। মাওলানা আতিকুরের তিন ছেলে—আবুল, হাসান ও ফয়জুল। এদের মধ্যে একজন কুয়েতে থাকে। ফয়জুলকে কারও সঙ্গে মিশতে দেখতাম না। সে মাঝে-মাঝে বাড়ির বাইরে আসতো, তবে কারও সঙ্গে মিশতো না। তাকে স্থানীয় কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যেতে দেখিনি। সে কোথায় লেখাপড়া করেছে, তা এখনও নিশ্চিত না।’
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জাফর ইকবালের ওপর হামলা
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফয়জুল্লাহ বলছিলেন, ‘ত্রিপল-ই (ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং) ফেস্টিভ্যাল চলছিল। শনিবার বিকাল ৫.৩৫। ফেস্টিভ্যালের এক পর্যায়ে বিকাল ৫.৩৫ এ ব্রেক দেওয়া হয়। ফেস্টিভ্যালে ৫ মিনিট ব্রেক দেওয়া হয়। ওই সময় স্যার মঞ্চেই ছিলেন। অনেক আগে থেকেই ছিলেন সেখানে। তো, যখন ব্রেক দিলো, তখন আমরা জাস্ট বিশ গজ দূরে এসে চা স্টলে দাঁড়ালাম চা পান করতে। ওখানে একটি চায়ের টং আছে, সেখানে গেছিলাম। আর ওই সময়টাতেই ঘটনা ঘটে।’
ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘একেবারে ব্রেক দেওয়ার প্রথম মিনিটেই ঘটনাটা ঘটছে। ছেলেটা আগে থেকেই মঞ্চে উঠে গিয়েছিল। মঞ্চে শিক্ষার্থীরা ছিল, মঞ্চের পেছনে চারজন পুলিশ ছিল। হামলাকারী সন্ত্রাসী আগে থেকেই মঞ্চে উঠেছিল। আর সুযোগ পেয়ে আঘাত করে বসে।’
হামলাকারীর পরিচয় সম্পর্কে ফয়জুল্লাহ জানান, ‘এখন পর্যন্ত তার কোনও পরিচয় আমরা পাইনি।’
হামলাকারীর বাড়িতে অভিযান
হামলাকারী ফয়জুলের বাড়িতে অভিযান শেষ করেছেন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। শনিবার দিবাগত রাত পৌনে দুইটার দিকে পুলিশ ও এর ২০ মিনিট আগে র্যাব অভিযান শেষে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এসময় তারা হামলাকারী ফয়জুলের মামা ফজলুল রহমানকে আটক করে নিয়ে যায়। একইসঙ্গে হামলাকারীর বাবা মাওলানা আতিকুর রহমানের বাড়ি থেকে বইপত্র ও সিডি নিয়ে যায় আইন-শঙ্খলা বাহিনী।
র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা বাড়ি ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি অভিযান চালান। এসময় চারটি কক্ষ থেকে কয়েকজনের জাতীয় পরিচয়পত্র, জিহাদি বই, একটি ছোরাসহ বিভিন্ন ধরনের আলামত সংগ্রহ করেন। কয়েকটি মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। তবে ওই বাড়িতে কারও ছবি পাওয়া যায়নি।
টুকেরবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহীদ আহমদ জানান, রাত একটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ফয়জুলদের ঘরে তল্লাশি চালিয়ে মাদ্রাসার বইসহ বিভিন্ন বই ও সিডি উদ্ধার করেছেন। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে বলেও তারা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মাওলানা আতিকুর রহমানের তিন ছেলে- আবুল, হাসান ও ফয়জুল। ফয়জুল সবার ছোট। হামলাকারীর পিতা টুকেরবাজারে মুখলেসিয়া মহিলা মাদ্রাসায় চাকরি করেন।’
দেশজুড়ে নিন্দার ঝড়
ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকেও নিন্দা জানানো হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে শাবির একাডেমিক ভবন ‘এ’-এর সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ-মিছিল করেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগেও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।
এছাড়া হামলার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান এবং সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একইসঙ্গে এই হামলাকারী বা হামলাকারীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বিজ্ঞান লেখক ড. জাফর ইকবাল মুক্তমনা স্বাধীনচেতা মানুষ। এ ধরনের একজন মানুষের ওপর হামলার অর্থ হচ্ছে— সত্য ও ন্যায় নিষ্ঠার ওপর আক্রমণ। অন্ধকারের অপশক্তিই এই আক্রমণ করেছে।’
বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post