‘জেনোসাইড’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত নতুন। দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ে আইনবিদ রাফায়েল লাম্পকিন তাঁর বিখ্যাত ‘নাজি’স ক্রাইম অন অকুপাইড ইউরোপ’ গ্রন্থে এই শব্দটি ব্যাবহার করেন। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেনো্সাইড শব্দটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। জেনো্সাইড কে অনেকে গণহত্যাও বলে থাকেন। কিন্তু গণহত্যা শব্দটি ব্যাবহার করলে জেনো্সাইড এর পুরোপুরি সঠিক অর্থ প্রকাশ পায়না। বর্তমানে আমাদের দেশে যে আন্তর্জাতিক অপরাধের(যুদ্ধাপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধ, শান্তি বিরোধী অপরাধ, জেনো্সাইড, আন্তর্জাতিক যুদ্ধসংক্রান্ত নীতি ও প্রথার লঙ্ঘন ইত্যাদি)বিচার হচ্ছে জেনো্সাইড তার মধ্যে অন্যতম। তাই জেনো্সাইড কি এবং কখন জেনো্সাইড হয় তা জানা থাকা প্রয়োজন।
নুরেমবার্গ ট্রায়ালে জেনো্সাইড শব্দটি সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি কিন্তু ভিন্ন অর্থে জেনো্সাইড এর দায়ে অভিযুক্তদের বিচার করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে জেনো্সাইড একটি একক এবং নির্দিষ্ট অপরাধ হিসাবে স্বীকৃতি পায় যখন জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ‘জেনো্সাইড কনভেনশন’ করে একে পৃথক একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা ট্রায়ালেও জেনো্সাইডকে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ হিসাবে বিচার করা হয়। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) এর সংবিধান নামে খ্যাত রোম স্ট্যাটুট এর অনুচ্ছেদ ৬ জেনো্সাইডকে সংজ্ঞায়িত করেছে যা প্রকৃতপক্ষে ‘জেনো্সাইড কনভেনশন’ ১৯৪৮ এ অনুচ্ছেদ ২ এর সংজ্ঞার অনুরূপ।
এই দুটি আন্তর্জাতিক আইনি দলিল অনুযায়ী জেনো্সাইড বলতে নিম্নবর্ণিত যেকোনো একটি কাজকে বুঝাবে যখন তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোন একটি জাতি, নৃগোষ্ঠি, বর্ণ অথবা ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারীদের সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দ্যেশে করা হবে। যেমন-
১। ওই জাতি, নৃগোষ্ঠি, বর্ণ অথবা ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারীদের হত্যা করা।
২। তাদের গুরুতর শারীরিক অথবা মানসিক ক্ষতিসাধন করা।
৩। উদ্দেশ্যমূলকভাবে সম্পূর্ণ বা আংশিক শারীরিকভাবে ধ্বংস করার জন্য তাদের উপর আক্রমণ করা।
৪। এমন কোন ব্যাবস্থা নেওয়া যেন তাদের মধ্যে সন্তান জন্ম নেওয়া(বংশবৃদ্ধি) বন্ধ হয়ে যায়।
৫। জোরপূর্বক এক গুষ্টির শিশুদের অন্য গুষ্টিতে স্থানান্তর করা।
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে জেনো্সাইড শব্দটি শুধুমাত্র জাতিহত্যায় সীমাবদ্ধ না। এর ব্যাপকতা অনেক। এমনকি একজন ব্যাক্তিও যদি কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে হত হন সেটিও জেনো্সাইড হতে পারে যদি তা উপরের সংজ্ঞার মধ্যে পরে। এমনকি জেনো্সাইড হওয়ার জন্য হত্যারও প্রয়োজন নাই। যদি কোন বিশেষ গুষ্টির নারী অন্যকোন গুষ্টির পুরুষের দ্বারা ধর্ষিত হন এবং সেই ধর্ষণের উদ্দেশ্য যদি এমন হয়যে ওই নারীর মাধ্যমে পুরুষটি যে গুত্রের ওই গুত্রের বীজ বপন করা অথবা ওই নারীর নিজের গুত্রের বংশবৃদ্ধি রোধ করা তাহলে সেটিও জেনো্সাইড হিসাবে বিবেচিত হবে যেমনটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের এদেশীয় দোসর দ্বারা সঙ্ঘটিত হয়েছিল।
কোন নির্দিষ্ট গুষ্টির শিশুদের অন্যকোন গুত্রে বলপূর্বক স্থানান্তরের ফলে তাদের মধ্যে নিজেস্য সংস্কৃতির প্রভাব থাকেনা। এভাবে ওই গুষ্টির কৃষ্টি, আচার, সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যায়। তাই এধরনের কাজকেও জেনো্সাইড হিসাবে গণ্য করা।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন জেনো্সাইড কোন সাধারণ অপরাধ নয়। এর বিস্তৃতি অনেক এবং গণহত্যাকে এর সমার্থক করা উচিত নয়। বরং গণহত্যাকে জেনো্সাইড নামক বিস্তৃত অপরাধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলা যেতে পারে। জেনো্সাইড এর ব্যাপকতার কথা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক আইনে একে “দি ক্রাইম অব দি ক্রাইমস বলা হয়ে থাকে”।
লেখকঃ রিচার্ড দত্ত, ‘মাস্টার্স অব ল’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।
Discussion about this post