রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
‘জেলা জজ’কে সাংবিধানিক পদ ঘোষণা সঠিক হয়নি দাবি করে রায়টির পুনর্বিবেচনা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আবেদনে ওই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত চাওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দিকে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আমরা রিভিউ দায়ের করেছি। এখন এটি শুনানির অপেক্ষায় আছে।
রিভিউ আবেদনে বলা হয়, রায়ে ‘জেলা জজ’কে সাংবিধানিক পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘জেলা জজ’ এবং ‘জুডিশিয়াল সার্ভিস’ টার্ম দুটিকে সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের সংজ্ঞায়ন অংশে শুধু সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ওই একইভাবে একই অনুচ্ছেদে ‘পাবলিক অফিসার’ এবং ‘সার্ভিস অব দ্য রিপাবলিক’ টার্ম দুটিকেও সংজ্ঞায়িত করা হয়। এ কারণে একই বিবেচনায় ‘পাবলিক অফিসার’ এবং ‘সার্ভিস অব দ্য রিপাবলিক’ও সাংবিধানিক পদ বিবেচিত হবে। বিষয়গুলো রায়ে সঠিকভাবে পর্যালোচনা হয়নি। ‘জেলা জজ’কে শুধু সাংবিধানিক পদ উল্লেখ করে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের ওপরের দিকের অবস্থানে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম নিয়ে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি রায় দেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ১০ নভেম্বর এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায়ে তিন দফা উল্লেখ করে বলা হয়, ১. সংবিধান যেহেতু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের শুরুতেই সাংবিধানিক পদাধিকারীদের গুরুত্ব অনুসারে রাখতে হবে। ২. জেলা জজ ও সমমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের ১৬ নম্বরে সচিবদের সমমর্যাদায় উন্নীত হবেন, ৩. এ ছাড়া অতিরিক্ত জেলা জজ ও সমমর্যাদার বিচার বিভাগীয় সদস্যদের অবস্থান হবে জেলা জজদের ঠিক পরেই, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের ১৭ নম্বরে।
এই তিন দফার আলোকে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) সংশোধন করতে বলা হয় ওই রায়ে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরকারের সব কাজ ও উৎসবে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোয় রাষ্ট্রের সব কাজে এটির ব্যবহার হয় না। এ কারণে হাইকোর্ট বিভাগ যথার্থই বলেছেন, জনগণের চোখে একজনের তুলনামূলক মর্যাদা পরিমাপের ক্ষেত্রে এই ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ই সরকারের একমাত্র পদ্ধতি। সাংবিধানিক পদধারীরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের সঠিক স্থানে নেই উল্লেখ করে বলা হয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং কিছু জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে সাংবিধানিক পদধারীদের ওপরে ১২ নম্বর ক্রমিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু সাংবিধানিক পদধারী যেমন, সংসদ সদস্যরা ১৩ নম্বর ক্রমিকে, অ্যাটর্নি জেনারেল, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, অম্বুডসম্যান (ন্যায়পাল) ১৫ নম্বর ক্রমিকে এবং পিএসসির চেয়ারম্যান ১৬ নম্বর ক্রমিকে রয়েছেন।
রায়ে জেলা জজদের ১৬ নম্বরে রাখার যুক্তি হিসেবে আদালত বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, বর্তমান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী হাইকোর্টের বিচারপতিদের রাখা হয়েছে নয় নম্বর ক্রমিকে। আর জেলা জজদের রাখা হয়েছে ২৪ নম্বরে। কিন্তু একজন জেলা জজকে যখন সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয় তখন তার পদক্রম যায় নয় নম্বরে। এভাবে সংবিধানে উল্লেখিত জেলা জজদের রাখাটা অবমাননামূলক ও লজ্জাজনক। কেননা জেলা জজ পদটি জুডিশিয়াল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ।
রায়ে বলা হয়, ওপরের আলোচনা থেকে মনে হয়েছে, তিন বাহিনীর প্রধানের ওপরে জেলা জজদের অবস্থান রাখাটা ঠিক হবে না। জেলা জজ ও সমমর্যাদার কর্মকর্তাদের প্রজাতন্ত্রের সচিব ও তাদের সমমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাখতে হবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ‘অধস্তন আদালতের বিচারকরা সাংবিধানিক পদধারী নয়’। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করলেও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কাজের ধরন বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সম্পূর্ণ আলাদা।
রায়ে বেসামরিক খেতাব স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং যেসব মুক্তিযোদ্ধা তাদের অবদানের জন্য বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছে, তাদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত হবে বলে মত দেওয়া হয়।
এদিকে রায়ের বেশ কিছু দিন পর রাষ্ট্রপক্ষ রায়টি রিভিউয়ের আবেদন করেছে। নির্ধারিত সময়ের পরে রিভিউ আবেদনটি দায়ের করায় ‘বিলম্ব মার্জনা’ও চাওয়া হয়েছে।
রিভিউ আবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে সংজ্ঞায়িত থাকায় রায়ে ‘জেলা জজ’কে সাংবিধানিক পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে ‘সার্ভিস অব দ্য রিপাবলিককে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রায়ে ১৩৩ অনুচ্ছেদ এবং পরবর্তী ১৩৪, ১৩৫ এবং ১৩৬ অনুচ্ছেদ সঠিকভাবে বিবেচনা করা হয়নি। এ ছাড়া রায়ে এর প্রতিফলনও ঘটেনি। সংবিধানের ৬২ অনুচ্ছেদে ‘ডিফেন্স সার্ভিস’, ১১৪ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালত এবং ‘নির্বাহী বিভাগের’ (সার্ভিস অব দ্য রিপাবলিক) বিষয়ে ১৩৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে। উপরন্তু প্রজাতন্ত্রের সব বিভাগ সংসদের অনুমোদিত আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হচ্ছে। প্রত্যেক বিভাগ আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে। এই বিবেচনায় ‘জুডিশিয়াল সার্ভিস’ অথবা ‘জেলা জজ’কে সাংবিধানিক বা অসাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার এবং ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের তালিকায় তারা বিশেষ অগ্রবর্তিতা পাবে, এটা কোনোভাবেই সঠিক নয়।
আবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৬ (এ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগে কর্মরত সব বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্য পরিচালনায় স্বাধীন হবেন। কিন্তু তারা সার্বভৌম নন। একমাত্র রাষ্ট্র সার্বভৌম এবং এটা সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্র সর্বভৌম এবং এর ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। কিন্তু রায়ে বলা হয়েছে, ‘বিচার কর্ম বিভাগের সদস্যরা সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ করেন।’ সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে এবং রাষ্ট্রপতিই একমাত্র সর্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন। বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু সার্বভৌম নয়। এ কারণে তারা রাষ্ট্রীয় কাজে বিশেষ গুরুত্ব দাবি করতে পারে না।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিচারিক বিবেচনাযোগ্য বিষয় নয় উল্লেখ করে আবেদনে আরও বলা হয়েছে, এটি শুধু একটি নটিফিকেশন এবং এটা শুধু রাষ্ট্রীয় উৎসবের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। আবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালত এবং অধস্তন আদালত নিয়ে বিচার বিভাগ। নিজের স্বার্থে আদালত নিজেই যদি সিদ্ধান্ত দেয় তা হলে তা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। রায়ে সরকার পক্ষের সাবমিশনকে গুরুত্ব না দিয়ে বিচার বিভাগের পক্ষের সাবমিশনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের মেরিট এবং রাষ্ট্র ও সরকার পক্ষের বিষয়কে গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে রায়টি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
সরকারের কার্যপ্রণালিবিধি (রুলস অব বিজনেস) অনুযায়ী ১৯৮৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২০০০ সালে এটি সরকার সংশোধন করে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব আতাউর রহমান। ওই রিটের ওপর ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ওই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বাতিল করে ৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে এটি নতুনভাবে তৈরি করতে বলা হয়। হাইকোর্টের এ রায় বাস্তবায়ন করলে প্রশাসনের মধ্যে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, এমন দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করে।
-আমাদের সময়
Discussion about this post