ভারতে জৈন ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে অনশনের মধ্যে দিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার যে রীতি বা ‘সান্তারা’ প্রচলিত আছে, দেশটির সুপ্রিম কোর্ট তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।
সব ধরনের খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়ে স্বেচ্ছায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়ার নামই সান্তারা–ভারতের জৈন সমাজের মধ্যে যে রীতি আজও প্রচলিত।
এর আগে রাজস্থান হাইকোর্ট তাদের এক রায়ে বলেছিল সান্তারা আত্মহত্যারই সামিল-কাজেই তা বেআইনি।
সারা দেশ জুড়ে জৈনরা এই রায়ের বিরুদ্ধে গত বেশ কিছুদিন ধরে বিক্ষোভ দেখিয়ে আসছিলেন-আজ শীর্ষ আদালতের রায়ে তারা স্বস্তি পেয়েছেন।
কিন্তু এ মাসেই রাজস্থান হাইকোর্ট একটি মামলার সূত্র ধরে রায় দিয়েছিল, এই ধরনের আমৃত্যু অনশনের মধ্যে কোনও মর্যাদা নেই এবং ভারতীয় সংবিধানের ২১ ধারা অনুযায়ী যে জীবনের অধিকার দেওয়া হয়েছে, সান্তারা তারও পরিপন্থী।
কিন্তু গত দু-তিন সপ্তাহ ধরেই এই রায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশের জৈন সমাজ রাস্তায় নেমে প্রবল বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। জয়পুর থেকে ইন্দোর, আওরঙ্গাবাদ থেকে সেকেন্দ্রাবাদ– যেখানেই জৈনরা বেশি সংখ্যায় আছেন, সেখানেই দেখা গেছে তীব্র আন্দোলন।
অবশেষে আজ সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তু আর অমিতাভ রায়ের বেঞ্চ রাজস্থান হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন–যার অর্থ সান্তারার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা আপাতত উঠে গেল।
সারা ভারত দিগম্বর জৈন মহাসভার প্রেসিডেন্ট নির্মল কুমার শেঠি সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন এই রায় শুধু জৈন সমাজের নয়–ভারতীয় সংস্কৃতিরই জয়।
তাঁর কথায়,‘জৈন সমাজের সবগুলো শাখা সান্তারার অধিকার চেয়ে শীর্ষ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল–আর এটা জৈনদের সব মুনি-ঋষি, আচার্যদের তপস্যারই ফল!’
জৈন সম্প্রদায়ের নেতারা এই রায়ে উল্লসিত হলেও একটা আইনি প্রশ্ন অবশ্য রয়েই যাচ্ছে–ভারতে আত্মহত্যা যেহেতু এখনও বেআইনি, তাই শুধু ধর্মীয় পরম্পরার দোহাই দিয়ে সান্তারা কীভাবে বৈধ হতে পারে?
রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: কুসুম জৈন অবশ্য মনে করেন দুটোর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। তাঁর মতে, ‘সান্তারা আর আত্মহত্যা এক নয় কারণ দুটোর প্রস্তুতি বা প্রক্রিয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সান্তারা একটা ধর্মীয় সাধণার অংশ, কিন্তু আত্মহত্যা অনেক সময়ই মানসিক অস্থিরতার পরিণাম। ফলে দুটো একেবারেই এক জিনিস নয়।’
রাজস্থান হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি জাস্টিস পি সি জৈনও সান্তারার সমর্থনে মুখ খুলে দাবি করেছেন–আত্মহত্যা একটা অপরাধ, ভারতে এই ভাবনাটাই এসেছে পশ্চিমী ধ্যানধারণা–বিশেষ করে ইংল্যান্ড থেকে।
তাঁর যুক্তি, পাদ্রীদের ওপর প্রবল বিশ্বাস থেকেই তারা ভাবতেন ঈশ্বরের দেওয়া শরীর নষ্ট করাটা অন্যায়–আর তাই আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যা করলে তার পরিবারের সম্পত্তি জব্দ করে নেওয়া হত, কবরস্থানেও জায়গা মিলত না।
‘কিন্তু প্রাচীন ভারতে এই ভাবনা কখনওই ছিল না, পরে তো পশ্চিমে ফ্রান্স-আমেরিকা-রাশিয়াও নিজের জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে’, বলছেন জাস্টিস জৈন।
সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায়ে জৈনদের সান্তারা আইনি বৈধতা পেলেও ভারতে ইউথেনেশিয়া বা ইচ্ছামৃত্যুর অধিকার কিন্তু আজও বেআইনি।
ফলে এখন কোনও জৈন ধর্মাবলম্বী চাইলে অনাহারে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে পারেন। কিন্তু মুম্বাইয়ের ধর্ষিতা নার্স অরুণা শানবাগ চল্লিশ বছরের ওপর জীবন্মৃত অবস্থায় কাটিয়েও মৃত্যুর অধিকার পাননি। সূত্র:বিবিসি বাংলা
Discussion about this post