বিদ্যমান তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের যে ধারাগুলো নিয়ে বিতর্ক ও ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে সেগুলো সংশোধিত ও পরিমার্জিত করে নতুন আইনে যুক্ত করা হবে। সে কারণে আইসিটি আইনের বিদ্যমান ৫৪ থেকে ৬৮ ধারা বাতিল হয়ে যাবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার।
অন্যদিকে, সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। শিশু থেকে বৃদ্ধ, শহর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত-সবখানে এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
‘সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস-২০১৬’ উপলক্ষে গতকাল শনিবার (১ অক্টোবর) রাজধানীতে আয়োজিত হয়েছে ‘সাইবার নিরাপত্তা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার। সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) তৃতীয় তলার স্বাধীনতা হলে এ সেমিনারের আয়োজন করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস (সিসিএ) ফাউন্ডেশন।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার, প্রধান অ্যালোচক ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. এম পান্না, মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনফরমেশন সিস্টেমস অডিট অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের (আই-সাকা) ঢাকা চ্যাপ্টার প্রেসিডেন্ট এ কে এম নজরুল হায়দার। এ ছাড়া আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিজের (সিসিএ) নিয়ন্ত্রক (যুগ্ম-সচিব) আবুল মনসুর মোহাম্মদ শারফ উদ্দিন, দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, সিসিএ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান।
সিসিএ উপদেষ্টা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুফি ফারুক ইবনে আবুবকরের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরো উপস্থিত ছিলেন, দৈনিক আমার কাগজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ফজলুল হক ভূইয়া রানা, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ জামাল, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুরসালিন নোমানী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক খায়রুজ্জামান কামাল প্রমুখ।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার বলেন, ‘সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা। আগামীতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সাইবার সচেতনতায় কর্মসূচি নেওয়া হবে।’
সাইবার নিরাপত্তার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকারের যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার তা শেষ পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে। এখানে যে আইসিটি পলিসি নেওয়া হচ্ছে তা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে উত্তম। বর্তমানের আইসিটি অ্যাক্টের বিভিন্ন বিতর্কিত দিকগুলো নতুন আইনে সংশোধন করা হবে, যেন অহেতুক কোনো মানুষ নির্যাতিত না হয়।’
তিনি আরো বলেন , ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলে তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ভুল বোঝাবুঝির যায়গাগুলো থাকবে না। ওই আইনের ৫৪ থেকে ৬৮ ধারাগুলো বাতিল হয়ে যাবে। সংশোধন ও পরিমার্জন করে সেগুলোকে নতুন আইনে সংযোজন করা হবে।’
নতুন আইনে নারী ও শিশু সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলেও জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যে সাইবার নিরাপত্তা বিষয় আরো বেশি অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম সাইবার বিষয়ে দক্ষ হয়ে গড়ে উঠবে, তাদের নতুন কর্মস্থলও সৃষ্টি হবে।’
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. এম পান্না বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গেলে প্রথমে থামুন, তারপর ভাবুন, তারপর আপনি যুক্ত হোন। আপনার জন্য কোনটা ভালো, আর কোনটা উপযোগী যা আপনার নিরাপত্তায় বিঘ্ন করবে না, তার সাথে যুক্ত হোন।’
ইন্টারনেটে কোনো আকর্ষণীয় পোস্ট দেখলেই তাতে ক্লিক না করে ভেবে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের সচেতনা তৈরি করতে হবে এবং এটি দরকার সব ক্ষেত্র।’।
ইনফরমেশন সিস্টেমস অডিট অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের (আই-সাকা) ঢাকা চ্যাপ্টার প্রেসিডেন্ট এ কে এম নজরুল হায়দার বলেন, ‘আমাদের দেশে সচেতনতা তৈরিতে নেতৃত্বের অভাব। সাইবার হামলা অনেকটা ভূমিকম্পের মতো; এটি হলে যেমন আমরা কিছুই করতে পারি না। কিন্তু পরে ঘুরে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারি।’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিজের (সিসিএ) নিয়ন্ত্রক (যুগ্ম-সচিব) আবুল মনসুর মোহাম্মদ শারফ উদ্দিন বলেন, ‘সচেতনতা তৈরির কাজ আমার। কিন্তু সিসিএ ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেটি করছেন। আগামীতে আমরা যৌথভাবে কীভাবে কাজ করতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা করব।’
সিসিএ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘সাইবার অপরাধের বেশি শিকার হয় নারীরা। নারীদের জন্য নিরাপত্তার বিষয়টি যে আলাদা করে ভাবা দরকার, সেটি সরকার বা অন্য কেউই ভাবছে না।’
অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু বলেন, ‘আমরা যারা অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালাই তাদের সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার ভাবতে হয়। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ভুল সংবাদ দিলে বিনা জামিনে ৭ বছরের কারাদণ্ড হয়। এজন্য অনেক সাংবাদিককেই জেল খাটতে হয়েছে। আবার একই ভুল যদি কোনো জাতীয় দৈনিক পত্রিকা করে তার ক্ষেত্রে কিছু হয় না। একই দেশে দুই নীতির শিকার আমরা, এটা ঠিক নয়।’
পরবর্তী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ বিষয়গুলো সংশোধন করা হবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।
যা কিছু কম্পিউটারাইজড-এর সবই হ্যাক হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেজন্য আমাদের সাইবার সিকিউরিটির বিষয়টি ভাবতে হবে। আবার তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিচরণের কারণে শিশুরা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি যেমন বাড়ছে তেমনি আমাদের ভোগান্তিও বাড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বিষয়ে কোনো পোস্ট দিলেই তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অথচ তার আইডি ব্যবহার করে অন্য কেউ এমন করেছে কি না, বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে না। তাই সাইবার নিরাপত্তার জন্য আইনের যেমন দরকার আছে, তেমনি যারা আইনটি প্রয়োগ করবে তাদেরও এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, শনিবার থেকে শুরু হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস অক্টোবর। ২০০৪ সাল থেকে আমেরিকা, ২০১১ থেকে নরওয়ে এবং ২০১২ থেকে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ এ মাসকে ‘সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস’ হিসেবে পালন করছে। সাইবার দস্যুতা থেকে নিরাপদে থাকতে মাসব্যাপী নানা কর্মসূচি নেওয়া হয় এ মাসে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এবার এটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে সিসিএ ফাউন্ডেশন।
Discussion about this post