কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও কে বা কারা তনুকে খুন করেছে, কেন খুন করেছে, তা উদ্ঘাটন করতে পারেনি মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। এমনকি তনুর পোশাক থেকে ধর্ষণের আলামতসহ তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায়, গত সাড়ে চার মাসে তা-ও সন্দেহভাজন কারও সঙ্গে মেলাতে পারেনি সংস্থাটি।
এই অবস্থায় চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন তনুর মা-বাবাসহ এই হত্যার বিচারের দাবিতে সক্রিয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। মামলার বাদী তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার কোনো কিনারা দেখতে পাচ্ছি না। সবাই আমার লগে বানছালি (ধোঁকাবাজি) করছে। এভাবে আর কত সহ্য করব? একটা ক্লুও পাওয়া গেল না।’
হত্যার ছয় মাস উপলক্ষে তনুর আত্মার শান্তি কামনায় গতকাল সকালে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মির্জানগর গ্রামের বাড়ির দুটি মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে তাঁর পরিবার।
এদিকে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে ডিএনএ প্রোফাইল মেলানো এবং তনু হত্যার বিচারের দাবিতে আজ মঙ্গলবার কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে প্রতিবাদী সংগীত এবং বাউলদের নিয়ে পদযাত্রার কর্মসূচি দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ, কুমিল্লা।
এই কর্মসূচির কথা জানিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লার অন্যতম সংগঠক খায়রুল আনাম রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, ছয় মাসেও এখন পর্যন্ত মামলার কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। দুই দফা লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা হয়নি। তনুর মা কয়েকজন সন্দেহভাজনের নাম এর আগে সিআইডি ও গণমাধ্যমকে বলেছেন। আজ পর্যন্ত কোনো সন্দেহভাজনের সঙ্গে তনুর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা মেলানো হয়নি। তদন্তের এই দশা তাঁদের সবাইকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে।
ডিএনএ প্রোফাইল না মেলানোর কারণ জানতে চাইলে মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জালাল উদ্দীন আহমেদ গতকাল সোমবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তনুর মা যাঁদের সঙ্গে ডিএনএ প্রোফাইল মেলানোর জন্য বলছেন, আমরা ওনার বক্তব্যের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ যাচাই-বাছাই করছি। হঠাৎ করে এগুলো করা যায় না। এ জন্য সময় লাগবে। সন্দেহভাজন ব্যক্তি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে ডিএনএ প্রোফাইল মেলানোর উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।’
গত ১ এপ্রিল মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরিত হওয়ার পর এর তদন্ত তদারক করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. নাজমুল করিম খান এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম। এর মধ্যে নাজমুল করিম খানকে গত ১১ জুলাই রাজশাহীতে বদলি করা হয়। এরপর তদন্তের গতি আরও মন্থর হয়ে যায় বলে মনে করছে তনুর পরিবার। আগস্ট মাসে গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম অসুস্থতার কথা বলে এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর গত ২৪ আগস্ট নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান সিআইডির এএসপি জালাল উদ্দীন আহমেদ। মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সিআইডির কুমিল্লা দপ্তরে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর তনুর মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছেন। ধারাবাহিকভাবে পরিবারের অন্য সদস্যদের মামলার বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে।
গত ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনু খুন হন। ওই দিন রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতরে ঝোপ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২১ মার্চ দুপুরে তনুর লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত হয়। ওই দিনই তাঁকে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা মির্জানগর গ্রামে দাফন করা হয়। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠার পর আদালদের নির্দেশে ২৮ মার্চ কবর থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত হয়। দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পর যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়, তাতে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন আসামি শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নমুনা (প্রোফাইল) প্রধান ভরসা। গত মে মাসে ডিএনএ প্রতিবেদন হাতে পায় সিআইডি। এরপর চার মাস পার হলেও সেটা কাজে লাগাতে পারেনি সিআইডি।
তনুর মা আনোয়ারা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিআইডির কোনো মাতবল (সাড়া) নেই। মেয়ে মরল আমার, অথচ কেবল আমারে চাপ দেয় ঘটনা নিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছি না। বিচারটা পেলে মনটা সান্ত্বনা পেত। দেশবাসীও খুশি হতো। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে আছেন, তিনি আমার দরদ বুঝবেন। আমি তাঁর কাছে বিচার চাই।
তনু হত্যার বিচারের দাবিতে টানা কয়েক মাস সারা দেশে ছাত্র-শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। এরপর একপর্যায়ে তা-ও স্তিমিত হয়ে যায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তনুর খুনি শনাক্ত না হওয়ায় আমরা হতাশ। একটি সংরক্ষিত এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার থাকা সত্ত্বেও ছয় মাসেও এ ঘটনার কোনো কূলকিনারা হলো না, বিষয়টি খুব দুঃখজনক। তবে আমরা এখনো আশা করছি, ঘটনার সঠিক তদন্ত হয়ে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’ সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post