এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ
আইন পেশায় থাকার সুবাদে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশার মানুষ সহ ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলাপচারিতায় অনেক সমস্যার আইনী সমাধান দিতে হয়। সেদিন সন্তান সম্ভাবা একজন মায়ের কান্না আমার হৃদয়কে বিচলিত করেছিল। গল্পটি আর দশটা ঘটনার মতো একটি যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা মাত্র। কিন্তু একটু ব্যতিক্রম! মেয়েটির মা-বাবা বেঁচে নেই। তিনি এখন খালার বাড়িতে আশ্রিতা। যত দিন গড়াচ্ছে, ততই মেয়েটির শংকা তার তালাক হয়ে যাবে। মেয়েটি এখন ৭ মাসের গর্ভবতী। গর্ভবতী হওয়ার পরপরই নিষ্ঠুর স্বামী তাঁকে তালাকের নোটিশ পাঠান। কারণ, তিনি তাঁর স্বামীকে যৌতুকের টাকা দিতে পারেননি। কিন্তু অনাগত সন্তান ও তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দিনাতিপাত করছে মেয়েটি। একান্ত আলাপচারিতায় এই আমাকে জানিয়েছেন মেয়েটি তাঁর দুঃসহ জীবনের কথা।
এই অসহায় মেয়েটির জন্ম ১৯৮৯ সালে। সেই হিসাবে তাঁর বয়স এখন চব্বিশের কোটায়। ছেলেটির জন্ম ১৯৮০ সাল। মেয়েটির চেয়ে নয় বছরের বড়। এদেশের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে জুটি হিসেবে হিসেবে হয়তো খুব মানানসই। কিন্তু বেশীদিন সইল না মেয়েটির সুখের কপাল। কাহিনীটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত-২০০৩) এর ১১ (গ) /৩০ ধারায় করা একটি মামলার আরজি এবং অন্যান্য দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এই ধারায় উল্লেখ আছে, যৌতুকের জন্য জখম করার জন্য অনধিক তিন বছর কিন্তু কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ড এবং এ দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ড হবে। ৩০ ধারা অনুযায়ী, এই আইনের অধীন কোনো অপরাধে প্ররোচনা দিলে মূল অপরাধটি করলে যে দণ্ড নির্ধারিত আছে, সেই দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
আরজির বিষয়বস্তুর সার সংক্ষেপ এরকম যে,
বিগত ১৫/০৫/২০১০ ইং তারিখে ১ নং আসামি অর্থাৎ মেয়েটির স্বামীর সাথে বাদিনীকে অথাৎ মেয়েটিকে মুসলিম শরা-শরিয়ত মোতাবেক ২ লক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য্যে বিবাহ হয়। যেহেতু বাদিনীর পিতা-মাতা কেউ জীবিত নেই, সেহেতু বিবাহের সময় বাদিনীর ভাই তার জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে আসামীদের আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র প্রদান করে। এরপর ১ নং আসামির সঙ্গে বাদিনীর উক্ত বিবাহ অনুষ্ঠিত হবার কয়েকদিন পার না হতেই আসামী বাদিনীর কাছে অর্থাৎ তার স্ত্রীর কাছে ব্যবসার জন্য দুই লক্ষ টাকা চায় এবং টাকা দিতে না পারলে বাদিনীকে তালাক দিবে বলে হুমকি প্রদান করে। তারপর তার ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন এবং চলতে থাকে। গত ২৫/০৮/২০১০ ইং তারিখে বেলা ১২.০০টায় ১নং আসামি বাদিনীকে বারবার দুই লক্ষ টাকা তার আত্মীয়স্বজনদের নিকট থেকে এনে দেওয়ার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও বাদিনী কেন এখনো টাকা এনে দেয় নাই, এ অজুহাতে বাদিনীর মাথার চুল ধরে এলোপাথারী মারতে শুরু করে। বাদিনী তখন জীবন বাঁচানোর জন্য অমন অবস্থা থেকে দৌড় দিয়ে দরজা খুলে তাঁর নিকটস্থ খালার বাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু কয়দিন থাকবে আশ্রিতার বাড়িতে। মেয়েটি আবার তাঁর স্বামীর বাড়িতে ফিরে যান। হয়তো অসহায় হয়েই। কিন্তু দুই লাখ টাকার লোভ যে তাঁর নিষ্ঠুর স্বামীকে দমাতে পারেনি। ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে মেয়েটিকে তার ঘরের ভেতর ডেকে নেয় এবং ধারালো অস্ত্র বের করে বলেন, ‘এক্ষণে ১৫০ টাকার খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর কর, নতুবা তোকে খুন করে ফেলব।’ মেয়েটি অসহায় হয়ে স্ট্যাম্পে সই করেন। তারপর মেয়েটিকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয়, ‘দুই লক্ষ টাকা নিয়া আসতে পারলে আসবি, নতুবা আসবি না।’ অসহায় মেয়েটি আবারো আশ্রয় নেয় খালার বাড়িতে। তারপর একটি করুণ ঘটনার মধ্য দিয়ে মেয়েটির জীবনে নেমে আসে অমানিসা অন্ধকার। ২৫ সেপ্টেম্বর মেয়েটির নামে তালাকের নোটিশ পাঠান ছেলেটি। কিন্তু মেয়েটি এখন কী করবেন, কোথায় যাবেন? মেয়েটির গর্ভে যে সন্তান। মেডিকেল প্রতিবেদন অনুযায়ী স্পষ্ট হয়, মেয়েটি সন্তানসম্ভবা। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, গর্ভবতী স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলেও সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় না। আইনে ইদ্দত কাল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,
১. বালেগা নারী অর্থাৎ পূর্ণ বয়স্ক নারী যার নিয়মিত হায়েজ হয়, তার ইদ্দতকাল তিন হায়েজ পর্যন্ত এবং হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়া হলে ইদ্দতকাল হবে উহার পরের পূর্ণ তিনটি হায়েজকাল।
২. অল্প বয়স্ক, বার্ধক্য, রোগব্যাধি বা অন্যকোন কারনে কোন নারীর হায়েজ না হলে তার মেয়াদ পূর্ণ তিন মাস।
৩. কোন নারীর স্বামী মারা গেলে তার ইদ্দতকাল চার মাস দশ দিন।
৪. কোন নারীকে তালাক দেয়ার পর ইদ্দতকালে স্বামী মারা গেলে তাকে স্বামী মৃত্যুর তারিখ থেকে চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে।
৫. গর্ভবতী নারীর ইদ্দতকাল গর্ভ খালাস হওয়া পর্যন্ত এর বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পর অন্তঃসত্তা প্রকাশ পেলে ইদ্দতকাল হবে গর্ভ খালাস পর্যন্ত।
ইদ্দত কখন শুরু হয়
১. স্বামীর মৃত্যুর দিন হতে বা তালাকের ক্ষেত্রে তালাকের দিন হতে,
২. মিলন অনুষ্ঠিত না হলে ইদ্দত পালনের দরকার নেই;
৩. মৃত্যুর সংবাদ ইদ্দতের সময় কাল পেরিয়ে যাবার পর তার নিকট পৌঁছিলে ইদ্দত পালনের দরকার নেই।
ইদ্দত চলাকালে বিবাহঃ
১. ইদ্দত চলা অবস্থায় বিবাহ করলে সে বিবাহ অনিয়মিত বিবাহ হিসেবে গণ্য হবে।
২. সন্তান জন্মিলে বৈধ হবে। তবে পক্ষগণের মধ্যে দায়-দায়িত্ব সীমিত হবে।
৩. স্বামী বা স্ত্রীর যে কোনো একজনের মৃত্যু হলে কেউ কারোর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে না।
ইদ্দতকালে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্বঃ
১. অন্য বিবাহ করতে পারে না।
২. স্বামীর যদি চারজন স্ত্রী থাকে, তাহলে তালাক ছাড়া চতুর্থ স্ত্রীর ইদ্দতকালের মধ্যে সে অন্য বিবাহ করতে পারবে না, তাকেও এই চতুর্থ স্ত্রীর ইদ্দত কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
৩. স্ত্রী স্বামীর কাছ হতে বা তার সম্পত্তি হতে কোন কোন ক্ষেত্রে ভরণ পোষন আদায় করতে পারবে।
৪. সাধারণতঃ তালাক দাতা স্ত্রী স্বামীর এবং স্বামীর স্ত্রীর উত্তরাধিকার হতে পারবে না। কিন্তু মৃত্যু ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই তারা উত্তরাধিকারী হতে পারে।
৫. ইদ্দতকালে স্ত্রী নির্ধারিত মোহরানা পাবে। তলবী মোহরানা না পেয়ে থাকলে তা সত্ত্বরই পাবে।
সন্ত্রাস যেমন আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে, যৌতুক প্রথাও তেমনি গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষতের মধ্যে জমে আছে শত শত নির্যাতনের বীভৎস চিহ্ন। রয়েছে অসহায় নারীদের বুকফাটা আর্তনাদ ও নির্যাতনের করুণ কাহিনী। যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে পাষন্ড স্বামী, আবার অনেক সময় পরিবারের সবাই মিলে ওই অসহায় স্ত্রীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আবার কখনো কখনো গলাটিপে হত্যা করতে তারা দ্বিধা করে না। কিংবা গল্পের মেয়েটির মতো তালাক দিতেও বুক কাঁপে না।
লেখকঃ সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া। E-mail: seraj.pramanik@gmail.com.
Discussion about this post