ড. বদরুল হাসান কচি
বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে উপকূলের প্রায় আড়াই লাখ জেলের জীবিকার চাকা ঘোরে। উত্তাল ঢেউ আর প্রকৃতির সাথে নিত্য লড়াই করে বেঁচে থাকা উপকূলের জেলেদের ভাগ্যে দূর্দশা পিছু ছাড়ে না কখনই। সমূদ্রের সাথে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সাহসী জীবন যোদ্ধার কাছে বড় আতংকের নাম জলদস্যু। একটি দস্যু বাহিনীর প্রধান ধরা পড়লে বা নিহত হলে বাহিনীর সদস্যরা নতুন করে এক বা একাধিক বাহিনী তৈরি করে। সমুদ্রে তাদেরই রাজত্ব। আর জেলেরা যেন নির্যাতিত প্রজা।
৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়াতনের সুন্দরবনের ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার স্থলভাগ ও ১ হাজার ৮৭৩ বর্গকিলোমিটার জলভাগের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে বনদস্যুরা রাজত্ব করছে। সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরে দস্যু বাহিনীগুলো এখনো সক্রিয়। একের পর এক অপারেশন চললেও কমেনি দস্যুতা। সুন্দরবন এখনো দস্যুদের দখলে। প্রতিনিয়ত তাদের চাঁদা দিয়েই জেলেদের মাছ ধরতে যেতে হয়।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, সুন্দরবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় এক ডজন দস্যুবাহিনী। চাঁদাবাজি আর অপহরণই তাদের প্রধান কাজ। সুন্দরবন ছাড়িয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত তাদের দৌরাত্য। বঙ্গোসাগরের জলদস্যুদের হামলা, অপহরণ, মুক্তিপণ বাণিজ্যে লাখ লাখ জেলে পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর ৫ হাজার জেলেকে জল দস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই থেকে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করা হলে জীবন দিতে হয়। এদিকে টলার ডাকাতির ব্যাপারে জেলেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থানায় মামলা করেন না। কারণ পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেন না। উপরন্তু দস্যুদের হাতে নাজেহাল হওয়ার ভয়।
ইলিশের মৌসুমে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন এলাকায় বেশী সক্রিয় থাকে দস্যু বাহিনী। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জেলেরা। তবুও শান্তিতে মৎস্য আহরণের আশায় দস্যুদের কাছ থেকে চড়া দামে ‘পাসকার্ড’ সংগ্রহ করে সাগরে নামেন জেলেরা। কিন্তু এই পাসকার্ড নিয়েও পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। এক বাহিনীর কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহ করলে অন্য বাহিনীর অত্যাচার বেড়ে যায় দ্বিগুণ। আবার যে বাহিনীর কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহ করা হয় তারাই বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চালায় নির্যাতন, জেলেদের আটকে রেখে আদায় করে মুক্তিপণ। চড়া দামের বিনিময়ে সংগ্রহ করা পাসকার্ডও তখন হয়ে যায় ভিত্তিহীন!
‘প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে মহাজনের কাছে বিভিন্ন দস্যু বাহিনী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সাগরে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে কার্ড করার পরামর্শ দেয়। কার্ড প্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করতে হয় মহাজনদের। যার মেয়াদ দেওয়া হয় এক বছর। বছর শেষে আবার কার্ড সংগ্রহ করতে হয়।’’ [সুত্র-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরকম.,জুলাই ২২, ২০১৫]
মহাজন, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও জেলেদের কাছে ভয়ংকর রুদ্রমূর্তি হচ্ছে জলদস্যু। ঝড়-বন্যার তবুও আলামত পাওয়া যায়, ডাকাতের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। হঠাৎ এসে এরা কেড়ে নেয় জেলেদের সর্বস্ব। মত্স্য শিকারে যাবার পর জেলের চিন্তায় ঘুমায় না স্বজনরা । আকাশে মেঘ নেই, গাঙ্গে বানের কিংবা তুফানের আলামত নেই। তবুও তাদের উত্কণ্ঠা। না জানি কখন হানা দেয়ে জলদস্যু। কেড়ে নেয় তাদের সবকিছু।
‘বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনকেন্দ্রিক জলদস্যুরা অপহরণ, ডাকাতি, লুটপাট, মুক্তিপণ ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে মৎস্যজীবী ও ট্রলার মালিকদের কাছ থেকে গত এক বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা ও বাগেরহাট জেলার মৎস্যজীবী ও ট্রলার মালিক সমিতি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ চার জেলার কমপক্ষে পাঁচ হাজার ট্রলার বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যায়। এর মধ্যে দেড় হাজার ট্রলার মালিককে দুই মৌসুমে (আষাঢ়-কার্তিক পর্যন্ত ‘ইলিশ’ ও অগ্রহায়ণ-জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত শুঁটকি) দস্যুদের টাকা দিতে হয়। দুই মৌসুমের জন্য দুটি টোকেন। প্রতি টোকেনের জন্য ট্রলার মালিকদের ৪০ হাজার টাকা করে গুনতে হয়। পিরোজপুরের পাড়েরহাট, বরগুনার পাথরঘাটা, বাগেরহাটের শরণখোলা, পটুয়াখালীর কলাপাড়া প্রভৃতি জায়গার জেলেরা দস্যু দলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে টোকেন সংগ্রহ করেন। এ খাত থেকে দস্যুরা চাঁদা তোলে প্রায় ১০ কোটি টাকা।
সমিতির হিসাবে, চলতি বছর উপকূলে এসব দস্যু বাহিনীর হাতে অপহৃত হন প্রায় দেড় হাজার জেলে। এসব জেলেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পণ দিয়ে মুক্ত করতে হয়েছে। গড়ে তিন লাখ টাকা হিসাবে দস্যুরা পণ আদায় করেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি বছরের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত দস্যুরা ২শটি মাছ ধরার ট্রলার লুট করে হাতিয়ে নেয় প্রায় চার কোটি টাকার সমপরিমাণ মাছ ও জাল।’’(সুত্র-দৈনিক আমাদের সময়, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫)
বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনে র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গত ৫ বছরে ১৭ বাহিনী প্রধানসহ ৭৪ জল ও বনদস্যু নিহত হয়েছে, উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র। তবুও থেমে নেই সাগর ও সুন্দরবন অঞ্চলে জলদস্যু ও বনদস্যুর তৎপরতা। এখনো গভীর সাগরে আতঙ্কে দিন কাটায় জেলেরা।
প্রশ্ন হলো ৫ বছরে মাত্র ৭৪ জন? আড়াই লক্ষ জেলের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন যেখানে জড়িত সেখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন উদাসীনতায় জনমনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে ? সদিচ্ছার অভাব নাকি অপারগতা প্রশ্ন থেকেই যায় ? এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় জেলেদের অপহরণের ঘটনা প্রায় ঘটে থাকে কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অপহরণের বিষয়ে কখনোই কোন বিবৃতি দিতে দেখা যায় না। আবার অপহরণের পর তাদের উদ্ধারে প্রচেষ্টাও থাকে দায়সারা। দেশের প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী নাগরিক হিসেবে উপেক্ষিত। এরা জলে জীবিকা খুঁজে, জলের পাশে এদের বসবাস; তাই বলে এরা অন্য কোন ভূখণ্ডের বাসিন্দা নয়, জেলেরা এই দেশেরই নাগরিক। নাগরিক হিসেবে তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে জীবন-জীবিকার জায়গায় নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রাখে। দেশের বিভিন্ন মিডিয়াগুলো কম বেশী এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খবরাখবর গুরুত্ব দেয় বলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার জায়গাটা এখনো আছে।
উপকূলের জেলে পল্লীগুলোতে কতো জেলে মারা গেছেন কিংবা নিখোঁজ রয়েছেন এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতিবছর শুধু ইলিশের মৌসুমে ২শ’ থেকে ৩শ’ জেলে নিখোঁজ হন। একজন জেলে মানে তার সাথে জড়িয়ে আছে পরিবারের আরো চার পাঁচজন মানুষ। তাই একজন জেলে নিখোঁজ হওয়ার সাথে তার পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে দস্যুর সংখ্যা কয়েকশ। ধরে নিলাম এই সংখ্যা হাজার। এই হাজার খানেক দস্যু বিপন্ন করে রেখেছে আড়াই লক্ষ জেলেসহ লক্ষ লক্ষ উপকূলবাসীকে। যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল সংকট থাকে তাহলে কেনো তারা জনবল বাড়াচ্ছেন না। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর দুর্বল বলে কি তারা অবহেলিতই থেকে যাবেন?
দেশের মোট রপ্তানি আয়ে মৎস্য সম্পদ থেকে আসে তিন শতাংশ। আবার রপ্তানিকৃত মাছের একটি সিংহভাগ হচ্ছে ইলিশ। গভীর সমুদ্রে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে ইলিশ মাছ ধরে এই জেলেরা। অবহেলিত এই জেলেদের ধরা মাছ পরবর্তীতে বিভিন্ন হাত ঘুরে পাতে উঠছে দেশের বিত্তবানদের এবং পাড়ি দিচ্ছে দেশ পেরিয়ে অন্য দেশে। ফিরে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ কথা বলার আর অবশিষ্ট থাকে না দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন এইসব জেলেরা।
এছাড়া সমুদ্রে মাছ শিকারে গিয়ে নিখোঁজ জেলে পরিবারের খোঁজ রাখে না কেউ। না ট্রলার মালিক, না মহাজন, না সরকার। আর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিখোঁজ জেলে পরিবারগুলো সমাজ থেকেও হয়ে যায় বিচ্যুত। এদের সুরক্ষার ব্যাপারেও রাষ্ট্র সমান উদাসীন।
তাই বৃহৎ স্বার্থে দস্যু নির্মূলের কোন বিকল্প নেই। এই বিষয়ে সরকার সহসাই সুনজর দিবেন বলে আশা করছি।
লেখক: আইনজীবী
Discussion about this post