চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত সবার জন্য নির্ধারিত দাপ্তরিক পোশাক রয়েছে। বিচারক, আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী ও পুলিশ সদস্যগণ নির্ধারিত এই পোশাক পরেন। কিন্তু এই নিয়ম মানেন না চট্টগ্রাম আদালতের প্রায় ৫০০ কর্মচারী। তারা নির্ধারিত পোশাক পরছেন না। অথচ প্রতি বছর নির্ধারিত দাপ্তরিক পোশাকের জন্য সরকারি ভাতা রয়েছে তাদের। কী কারণে বেশিরভাগ আদালত কর্মচারী নির্ধারিত পোশাক পরেন না তার ইঙ্গিত মিলেছে এক অনুসন্ধানে।
অভিযোগ আছে, আদালত কর্মচারীদের কেউ কেউ কর্মস্থলে আসেন প্রাইভেটকার হাঁকিয়ে। কারো কারো রয়েছে নিজস্ব বাড়ি–ফ্ল্যাট। কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেছেন, আদালতের পিয়ন থেকে শুরু করে পেশকার–প্রসেস সার্ভার সবার বাড়ি–গাড়ি, ফ্ল্যাট আছে। পোশাকে আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য কর্মচারীদের অনেকেই সরকারি পোশাক পরতে অনীহা দেখান।
এ দিকে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ থাকার কারণে চট্টগ্রামের আদালতগুলোতে কর্মচারী সংকট রয়েছে। অনেক আদালতে বেঞ্চ সহকারী হিসেবে কাজ করছেন নিম্ন পদের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা। আবার কর্মচারী সংকটের কারণে প্রত্যেক আদালতে সরকারী কর্মচারীদের সাথে পেশকার, সেরেস্তাদার, নাজীর ও পুলিশের নিয়োগ করা বহিরাগতরা কাজ করেন। সুবিধামতো পরিচয় দিতে ও বহিরাগতদের নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ করে দিতে বেশিরভাগ আদালত কর্মচারী নির্ধারিত পোশাক পরেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ৮৬টি আদালতে কর্মরত আছেন প্রায় ৫০০ সরকারি কর্মচারী। এ সব কর্মচারীর নির্ধারিত দাপ্তরিক পোশাক পরার নিয়ম আছে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া বেশিরভাগই নির্ধারিত পোশাক পরেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের ৮৬টি আদালতের এজলাস, সেরেস্তা, রেকর্ড রুম, নেজারত, জিআরও শাখায় পাঁচ শতাধিক বহিরাগত কাজ করেন। আদালত অঙ্গনে তারা উমেদার হিসেবে পরিচিত। এ সব উমেদারকে স্বাভাবিকভাবে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তারা বহিরাগত। তাদের ব্যবহার করে সরকারী কর্মচারীরা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা উপার্জন করেন বলে অভিযোগ। উমেদারদের দৈনিক সর্বনিম্ন পাঁচশ’ টাকা থেকে হাজার টাকা বেতন দেন নিয়োগ কর্তারা। একজন পেশকার, সেরাস্তাদার, পুলিশ জিআরও গড়ে তিন থেকে চারজন করে উমেদার নিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
গত ১৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ–সচিব নাঈমা হোসেন সাক্ষরিত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। ওই পরিপত্রে জাতীয় বেতন স্কেলের ১৬ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের দাপ্তরিক পোশাক ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যদির মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ওই পরিপত্র অনুযায়ী এ সব গ্রেডের কর্মচারীদের দাপ্তরিক পোশাক বাবদ সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, আদালতে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নাজির, বেঞ্চ সহকারী (পেশকার), মুদ্রাক্ষরিক ছাড়া অন্য সকল কর্মচারী ১৬ থেকে ২০ গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রেডের মধ্যে আদালতে কর্মরত ক্যাশিয়ার, ক্যাশ সরকারী, অফিস সহকারী, ডেসপাস সহকারী, হিসাব সহকারী, টাইপিস্ট, সহকারী রেকর্ড কীপার, জুডিসিয়াল পেশকার, স্টোরকিপার, অফিস সহায়ক, প্রসেস সার্ভার,জারিকারক, দপ্তরী, সুইপার, নাইটগার্ড, মালিম, ডেসপাস রাইটার, ফটোকপি মেশিন অপারেটর রয়েছে। এদের নির্ধারিত পোশাক পরা বাধ্যতামুলক।
অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জজশীপ কর্মচারী সমিতির সভাপতি মো. পারভেজ বলেন, ‘নির্ধারিত দাপ্তরিক পোশাক পরে কাজ করলে আদালত অঙ্গনে অনেক অনিয়ম–দুর্নীতি কমে যাবে। এখন পোশাক না থাকায় অনেক টাউট শ্রেনীর মানুষ নিজেকে আদালতের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করার সুযোগ পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার পরিপত্র জারি করেছে সত্য কিন্তু অর্থ বরাদ্দ করেনি। অর্থের বরাদ্দ পাওয়ার পর নেজারত শাখা নিয়মমতে ঠিকাদার নিয়োগ করে পোশাকের ব্যবস্থা করে। এরপর কর্মচারীরা পোশাক পায়।’
পোশাকের জন্য অর্থ বরাদ্দ না থাকার দাবি চট্টগ্রাম জজশীপ কর্মচারী সমিতির সভাপতি মো. পারভেজ করলেও গতকাল সোমবার সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ, চট্টগ্রাম মহানগর ও দায়রা জজ এবং চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের কর্মচারীরা নির্ধারিত পোশাক পরেছেন। পোশাকের জন্য অর্থ বরাদ্দ না থাকলে তিন আদালতের কর্মচারীরা কিভাবে পরছেন সে প্রশ্ন তুলে ধরলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান চট্টগ্রাম জজশীপ কর্মচারী সমিতির সভাপতি মো. পারভেজ।
এদিকে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কফিল উদ্দিন চৌধুরীর মতে, মূলত পরিচয় গোপন করে প্রতারণা করতে আদালতের কর্মচারীরা নির্ধারিত পোশাক পরতে আগ্রহ দেখান না। চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘আদালত অঙ্গনকে টাউটমুক্ত করতে আইনজীবী, শিক্ষানবীশ আইনজীবী ও এডভোকেট ক্লার্কদের পরিচয়পত্র ও নির্ধারিত পোশাক পরার ব্যবস্থা করেছি আমরা। আদালতের কর্মচারীদের পোশাকের ব্যবস্থা আছে। আদালতে অনেক উমেদার কাজ করেন। তারা আদালতের কর্মচারী নয়। কিন্তু তারা নিজেদের আদালতের কর্মচারী বলে পরিচয় দেন। আবার দেখা যায় অনেক কর্মচারী পেশকার না হয়েও নিজেকে পেশকার,নাজীর পরিচয় দেন। তারা নিজেদের সুবিধামতো পরিচয় দেওয়ার জন্য পোশাক পরেন না।’
তিনি আরও বলেন, আদালতকে টাউটমুক্ত করার জন্য চট্টগ্রাম বারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আদালতের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে শতভাগ টাউট, দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হবে।’
তথ্য সুত্রঃ দৈনিক আজাদী
Discussion about this post