একেএম নাজিমঃ ‘বর্তমানে ক্বওমী মাদ্রাসা ও তার শিক্ষা ব্যবস্থা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনকভাবে রয়েছে’ বলে গত ৭ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে এনজিও প্রতিনিধিদের এক মতবিনিময় সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত যে মন্তব্য করেছেন, তার তীব্র নিন্দা ও কঠোর সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ ক্বওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক) সভাপতি হেফাজতে ইসলামের আমীর এবং দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী। একই মতবিনিময় সভায় আগামী বাজেটে মাদ্রাসা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমানোসহ ইসলামী শিক্ষা বিরোধী বক্তব্যের অভিযোগ এনে এনজিও প্রতিনিধিদের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, দেশ ও জাতির জন্য অর্থমন্ত্রী ও এনজিওরাই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হয়ে ওঠছে। গতকাল (রবিবার) বিকেলে সংবাদপত্রে দেওয়া বিবৃতিতে হেফাজত আমীর বলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ঘুষ, সুদ, ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে চরম বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার পর এবার ইসলামী শিক্ষার সূতিকাগার ক্বওমী মাদ্রাসার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন। এর আগে তার বিভিন্ন ইসলাম ও নৈতিকতা বিরোধী বক্তব্যের বিরুদ্ধে দেশের উলামায়ে কেরাম তীব্র প্রতিবাদ জানানোর পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি থেমে থেমে একটার পর একটা ইসলাম বিরোধী বক্তব্য দিয়েই চলেছেন। অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য চরম নিন্দনীয়, উস্কানীমূলক ও উদ্বেগজনক। তার বক্তব্য উলামা-মাশায়েখসহ কোটি কোটি তাওহিদী জনতাকে মানসিকভাবে আহত করেছে।
বিবৃতিতে হেফাজত আমীর বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে ক্বওমী মাদ্রাসার ৩০০ বছরের গৌরবগাঁথা ইতিহাস রয়েছে। সেই বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দেশ ও আদর্শ জাতি গঠনে ক্বওমী মাদ্রাসার অবদান ও ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়ে চলেছে। দেশের মুসলিম জনসাধারণ এসব মাদ্রাসার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্ত আর্থিক অনুদানসহ নানাভাবে অব্যাহত সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। এসব মাদ্রাসার ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা এতে সহজেই প্রমাণিত হয়।
বিবৃতিতে হেফাজত আমীর আরো বলেন, চলমান ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সরকারি শিক্ষাখাতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। অথচ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়ালেখা করানোর খরচ চালাতে গিয়ে মা-বাবাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে, সন্তানদের পড়ালেখার খরচের জন্য অনেক অভিভাককে সহায়সম্বল ও জমিজমা বিক্রি করতে হচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের এই বিশাল অর্থের সুবিধা কারা নিচ্ছে? আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষাখাতে সরকারী আর্থিক বরাদ্দের ব্যবহারে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম গোপন কিছু নয়। অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ ও বইপত্র ছাপানো থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই ব্যাপক দূর্নীতি ও লুটপাটের খবর প্রচার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শাসকদল ও অপরাপর রাজনৈতিক দলসমূহের প্রভাববলয় তৈরীর উদ্দেশ্যে ছাত্রদেরকে ব্যবহার করার কারণে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, অস্ত্রবাজি, খুনাখুনি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মত ঘটনা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারী বরাদ্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নকলবাজি, শিক্ষার মানগত অধোগতি এবং পড়ালেখার সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ কতটা বজায় রয়েছে, সে সম্পর্কে সকলেই অবগত আছেন।
হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী আরো বলেন, ক্বওমী মাদ্রাসামূহ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ না করেও সাধারণ জনগণের সার্বিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে প্রায় ৪০ হাজার ক্বওমী মাদ্রাসায় গরীবদের জন্য ফ্রি হোস্টেল ও খোরাকী সুবিধাসহ সম্পূর্ণ অবৈতনিক শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের মাঝে সুশিক্ষা ও জ্ঞানের আলো পৌঁছে দিচ্ছে। ক্বওমী মাদ্রাসামূহে নকলবাজি, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, প্রকাশ্য অস্ত্রবাজিসহ কোন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, রাজিৈনতক দলাদলি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা নেই। আমরা লক্ষ লক্ষ ছাত্রকে পবিত্র কুরআন-হাদীসের শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। আমরা ছাত্রদেরকে সূদ, ঘুষ, খুনাখুনি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, জোর-জুলুম, দূর্নীতি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-ব্যভিচার, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ও অন্যের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে থাকি। পাশাপাশি আমরা ছাত্রদেরকে ন্যায় ও শান্তির পথে চলা, পরিবার সমাজ ও দেশে সম্প্রীতি গড়ে তোলা, সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সকলের সাথে সদ্ভাব ও সদাচরণ বজায় রেখে সততা ও ইনসাফের সাথে চলার প্রতি কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করি। ক্বওমী মাদ্রাসা পড়–য়া এদেশের লক্ষ লক্ষ আলেম ও মসজিদের ইমাম বক্তব্য ওয়াজ-মাহফিল ও আলোচনা সভায় মানুষকে প্রকৃত মুসলমান, দেশপ্রেম, সুনাগরিক এবং আইন মেনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। দেশ ও জাতিগঠনে ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহের এই বিশাল ভূমিকা ও অবদানের কারণেই এসব মাদ্রাসার ব্যয় নির্বাহসহ যেকোন প্রয়োজনে সাধারণ জনগণই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। মূলতঃ বরাদ্দ পেতে সুদ, ঘুষ, দূর্নীতিসহ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক অপব্যবহারে জড়িয়ে ফেলা এবং সরকারের ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন নির্দেশনা পালনে বাধ্য করার পাশাপাশি পাঠ্যক্রমে মৌলিক ইসলামী শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করার আশংকা থেকেই ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহ সরকারী অর্থ গ্রহণে অনুৎসাহিত বোধ করে থাকে। এসব আশংকা থেকেই গত মাসে ভারতে বিজেপি সরকারের ৩০০ কোটি রুপির আর্থিক সহায়তা প্রস্তাব দারুল উলূম দেওবন্দ ও তার অনুগামী ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহ প্রত্যাখ্যান করেছে।
হেফাজত আমীর বলেন, পশ্চিমা বিশ্বে পড়ালেখা করা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সূদ, ঘুষ, শেয়ার বাজার, আর্থিক দূনীতি ও ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত ও নৈতিকতা বিরোধী বক্তব্য দিয়ে আলেম সমাজসহ জাতির কাছে চরম সমালোচিত হয়েছেন। সর্বশেষ এনজিওদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এদেশে নৈতিক ও আদর্শ শিক্ষার সূতিকাগার ক্বওমী মাদ্রাসার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে তিনি যে কার্যতঃ ইসলাম বিদ্বেষীদের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছেন, তা প্রকাশ করে দিলেন। হেফাজত আমীর বলেন, অর্থমন্ত্রী একের পর এক গর্হিত বক্তব্য মেনে নেয়ার কোনই সুযোগ নেই। এটা মুসলিম অধ্যুষিত শান্তিপ্রিয় দেশ। যাচ্ছে তাই ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে শান্তি বিনষ্ট করার সুযোগ দেয়া যায় না। তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে মন্ত্রীসভা থেকে বহিষ্কার দাবী জানিয়ে বলেন, ধারাবাহিকভাবে ইসলাম ও নৈতিকতা বিরোধী বক্তব্য দেয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে সরকারকে অনতিবিলম্বে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় তৌহিদী জনতার ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলে এর দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কোন অবস্থাতেই ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আল্লাহ-রাসূলের অবমাননা ও ইসলাম বিদ্বেষী অপতৎপরতা এদেশের আলেম সমাজ ও তৌহিদী জনতা চলতে দিবে না।
বিবৃতিতে হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী ৭ এপ্রিল মঙ্গলবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রীকে ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার জন্য এনজিও কর্মকর্তা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম “মাদ্রাসা শিক্ষায় মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। এই শিক্ষার নামে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের জঙ্গি বানাচ্ছি কী না- তা ভেবে দেখার সময় এসেছে” বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারও তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, মাদ্রাসায় নয়, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতেই প্রতিদিন খুনাখুনি, অস্ত্রবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হচ্ছে। আর এসবে ইন্ধন যোগিয়ে চলেছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট এনজিওরাই। এনজিওরা দেশীয় সংস্কৃতি ও মুসলিম জাতিসত্তার পরিচিতি মুছে এদেশে নাস্তিকতা ও বেহায়াপনা চালু করতে চায়। পাবর্ত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদেরকে উস্কানী দিয়ে তারা খ্রীস্ট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শিক্ষা ও আর্থিক সহযোগিতার নামে কৌশলে কোমলমতি শিশু ও দুস্থ-গরীবদেরকে তারা খ্রীস্টান ধর্মের দীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মুসলিম জাতিসত্তা ও দেশের স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত এনজিওদের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবী জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আছে, বিভিন্ন এনজিও বাংলাদেশে ১৭টি আ লিক ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ কপি ছাপিয়ে তাতে ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করে সরল ও অর্ধ শিক্ষিত মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে।
বিবৃতিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফী হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি বাতিল এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশে অনৈতিকতা, বেহায়াপনা ও জোর-জুলুমের বিস্তারের পাশাপাশি রাসূল অবমাননা, ইসলাম বিরোধী বক্তব্য, ধর্মহীনতার চর্চা এবং ইসলাম বিরোধী এনজিওদের অপতৎপরতা আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। মূলতঃ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার দিকেই দেশকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে, জাতি এখন তা উপলব্ধি করতে পারছে। তিনি ইসলাম ও দেশবিরোধী ব্যক্তি, সংগঠন ও এনজিওদের ব্যাপারে গণসচেতনতা তৈরীর জন্য দেশের আলেম সমাজ ও হেফাজতের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
Discussion about this post