সিরাজ প্রামাণিক
প্রকৃতিগত কারণে একজন নারী একজন পুরুষ থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। সে কারনেই নারীরা বহুলাংশে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। এ সুযোগে কিছু পুরুষ তাদের প্রত্যাশিত আচরণ রীতি ভুলে গিয়ে নারীদেরকে অসৎ কাজে ব্যবহারে উদ্যোগী হয়। এতে নারীরা হয় নির্যাতিত, নিষ্পেষিত অধিকারচ্যূত। এরকম গর্হিত অপরাধ প্রতিরোধে সরকার ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ণ ও প্রবর্তণ করেন। এরপর নারী ও শিশুদের উপর পরিচালিত অত্যাচারের মাত্রা আরও কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ২০০৩ সালে এ আইনটির ব্যাপক সংশোধন, সংযোজন ও পরিবর্তন করেন। নারী কোন পুরুষ কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হলে এ আইনের অধীন কি ধরণের প্রতিকার পেতে পারে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন ভীতি প্রদর্শন করিয়া বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করে তাহা হলে তিনি কোন নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে’। অর্থাৎ ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।
২ উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো নারী কোনো পুরুষ কর্তৃক ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী ওই পুরুষের কোনো কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
৩ উপধারায় বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধ ভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
৪ উপধারায় (ক) তে বলা হয়েছে, ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন।
৪ উপধারায় (খ) তে বলা হয়েছে, যদি ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছরের কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন।
৯ এর ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোনো নারী ধর্ষিত হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরুপ ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিত নারীর ফোজতের জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন, তিনি বা তারা হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বছরের কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা ও সাজার ধরণ দেখে একথা ষ্পষ্ট করে বলা যায় যে, একজন ধর্ষণকারী পশুরও অধম। এখন দেখা যাক একটি ধর্ষণ মামলায় অপরাধীর দোষ প্রমাণের মাপকাঠি কী? উত্তর হওয়া উচিত ধর্ষিতার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। অথচ এ সহজ উত্তরটির অধিকারিণী হতে বাংলাদেশের নারীসমাজকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বিচারপতি গোলাম রাব্বানী স্যারের লেখা এক কেইস ষ্টাডি থেকে জানা যায়, ১৯ বছরের এক গরীব যুবতী গৃহবধূ সালমা। শীতের এক রাতে ওই গৃহবধূ পিতৃগৃহ থেকে রিকশায় চেপে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ঢাকার মিরপুরে সনি সিনেমা হলের কাছে পৌঁছালে চারজন লোক তাঁকে জোরপূর্বক রিকশা থেকে নামিয়ে অস্ত্রের মুখে এক বাড়িতে নিয়ে যায়। রিকশাওয়ালাকে মারলে ও ভয় দেখালে সে পালিয়ে যায়। এরপর সেখানে নিয়ে ড্রইংরুমের মধ্যে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ চারজনের মধ্যে তিনজনকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করে ও অবশেষে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ আদালতে তাদের বিচার করা হয়। আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ও আরো দাবি করে যে সালমা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় পতিতাবৃত্তি করে এবং এ অবৈধ কাজে বাধা দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এ মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।
আদালতে সালমা আরজীর বিষয় বর্ণনা ও সমর্থন করে সাক্ষ্য প্রদান করেন। ওই ঘর থেকে পুলিশ টিভি, ভিসিআর, ক্যাসেট ও বন্দুক সিজ করে। সিজ করা টিভি ও বন্দুক কোর্টে প্রদর্শিত হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক সালমাকে পরীক্ষা করেন এবং তিনি আদালতে সাক্ষী দেন যে, সালমার পাঁজর, ঊরু, নিতম্বে আটটি জখম, অর্থাৎ ধস্তাধস্তির চিহ্ন পেয়েছেন এবং তাঁকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়েছে। মামলায় আরো ছয়জন সাক্ষী দেন। তাঁরা হলেন এজাহারের লিপিকার দারোগা, থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা, একজন সহকারী দারোগা ও একজন কনস্টেবল। অপর দুজন সিজারলিষ্টের সাক্ষী যাদের উপস্থিতিতে ঘটনাস্থল থেকে টিভি, ভিসিআর, ক্যাসেট ও বন্দুক জব্দ করা হয়েছিল।
সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির ভিত্তিতে ওই বিশেষ আদালত আসামি তিনজনকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী করেন এবং জরিমানাসহ সাত বছর সশ্রম কারাদ- দেন। এরপর দ-প্রাপ্তরা সাজার আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করে। বিচারপতি নঈমুদ্দিন আহম্মদ ও বিচারপতি গোলাম রাব্বানীর দ্বৈত বেঞ্চে বসাকালীন আপিলটির শুনানি হয় এবং নিম্ন আদালতের রায়টি সঠিক আছে বলে ওই বেঞ্চ আপিলটি ডিসমিস করে দেন। সেই সাথে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেন যে, যেহেতু ধর্ষিতা নিজেই জখমী, কাজেই তাকে জখমি সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সুতরাং ধর্ষিতাকে একজন সহযোগী ও তাকে অন্য সাক্ষী দ্বারা ঘটনাটিকে প্রমাণ করতে হবে এমন প্রাচীন আইনি ধারণা সঠিক নয়।
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রুপ রায় ও আদেশের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়ে আসামী পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করে। আপিল বিভাগ প্রাচীন আইনি ধারণাটি অনুসরণ করে রায় প্রদান করেন। এই রায়ে বলা হয়েছে ‘এই মোকদ্দমার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী সালমা নিজেই ভিকটিম হওয়ায় এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে সালমা সত্য কথা বলেছে কি-না এবং তাঁর সাক্ষ্যের প্রত্যক্ষ বা অবস্থানগত সমর্থন প্রয়োজন কি-না।’ অতঃপর সালমার ও অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে আপিল বিভাগ সালমাকে অবিশ্বাস করেন। ফলে আপিল বিভাগ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ আদালতের রায় এবং মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাতিল করেন ও আসামি তিনজকে বেকসুর খালাস দেন। আপিল বিভাগের ওই রায়টি পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনস’-এর ১৩০০ খ-ের ৭৯৮৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে।’
আরেকটি কেস ষ্টাডিতে জানা যায়, ঘটনার তারিখ ২৭ আগস্ট, ২০০৯। ওই মামলার ঘটনায় ভিকটিম ময়না খাতুন (১৬) (ছদ্মনাম)। তার আরও দু’বার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় বর্তমান বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। তিনি থানায় অভিযোগ করেন যে প্রতিবেশী আসামি হান্নান তার সঙ্গে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এরপর প্রায় ছয়-সাত মাস ধরে তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করে। অন্যদের অনুপস্থিতিতে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বেশ কয়েকবার যৌনকর্মে মিলিত হয়। যার ফলে ভিকটিম ময়না খাতুন গর্ভবতী হয়। গর্ভবতী হওয়ার পাঁচ মাস পর ভিকটিম তার মাকে জানায় এবং এ ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদে একটি সালিসও হয়। আসামি হান্নান ভিকটিম ময়না খাতুনকে বিয়ে করতে অস্বীকার করায় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সিদ্ধান্তে আসামিকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৯ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে ‘ কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের অধিক হয় তা হলে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি থাকলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না এবং যৌনকর্মের সঙ্গীকেও দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া যাবে না। তবে যে কোনো নারীর সম্মতি যদি ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অথবা প্রতারণামূলকভাবে আদায় করা হয় তা হলে ওই সব ক্ষেত্রে যৌনকর্ম ধর্ষণের নামান্তর এবং যৌনকর্মের সঙ্গীও ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে। উপরোক্ত কেস ষ্টাডিতে বিচারক বিচার-বিশ্লেষণ করে এ মামলায় আসামি হান্নানকে খালাস দেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘটনার সময় ভিকটিমের বয়স কমপক্ষে ১৬ বছর ছিল। এর আগে তার দুবার বিয়ে হয়েছিল এবং আসামির সঙ্গে তার একাধিকবার যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া ভিকটিমের স্পষ্ট সন্মতি ছিল। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক
Discussion about this post