বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানি ঘটানোর শাস্তি নতুন আইনেও তিন বছর কারাদণ্ডই থাকছে। সাজা বাড়ানোর দাবি ছিল পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের। কিন্তু তা আমলে নেয়নি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর বহাল রাখাসহ ১১৭টি সুপারিশ গত ১৮ জুলাই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে বিআরটিএ। যদিও মালিক-শ্রমিক সংগঠন ছাড়া পরিবহন খাত-সংশ্লিষ্ট অন্য অংশীদাররা (স্টেকহোল্ডার) সাজা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীও একাধিকবার বলেছেন, তিনি সাজা বাড়ানোর পক্ষে। নাগরিক সমাজের অভিযোগ, পরিবহন মালিক-চালকদের চাপে নতিস্বীকার করে গুরুপাপে লঘুদণ্ড বহাল রাখা হচ্ছে।
বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) মশিয়ার রহমান জানান, সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ার ওপর সব পক্ষের মতামত যাচাই-বাছাই করে সুপারিশমালা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর ভিত্তিতে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। সড়ক পরিবহন সচিব এম এ এন ছিদ্দিক গণমাধ্যমকে জানান, আগামী ঈদের আগেই খসড়া চূড়ান্ত হবে। এরপর অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় যাবে। সেখানে অনুমোদিত হলে সংসদে উত্থাপিত হবে।
পরিবহন খাত চলছে ৭৭ বছরের পুরনো ‘ভারতীয় মোটরযান আইন-১৯৩৯’ আইনে। আইনটি পরিমার্জন করে ১৯৮৩ সালে জারি করা হয় ‘মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩’। তাতে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানি ঘটালে ১৪ বছর জেলের বিধান ছিল। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে পরবর্তী তিন বছরে দুই দফায় শাস্তি কমে তা ঠেকে তিন বছরে। অধ্যাদেশটি যুগোপযোগী এবং কঠোর করতেই সম্প্রতি সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার।
২০১০ সালে শুরু হয় সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের কাজ। পরের বছর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রণীত খসড়ায় বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানির সাজা ১০ বছর কারাদণ্ড এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছিল। খসড়াটি পর্যালোচনায় ২০১৩ সালে কমিটি পাঁচ বছর কারাদণ্ডের সুপারিশ করে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মামলা জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্যেরও সুপারিশ করা হয়। সর্বশেষ প্রণীত খসড়ায় এসব সুপারিশ বাদ দেওয়া হয়। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানির বিচার ৩০২ ধারায় করার দাবিও আমলে নেয়নি বিআরটিএ।
দুর্ঘটনার মৃত্যুর বিচারে ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে অন্তত পাঁচটি মামলা হয়েছিল ৩০২ ধারায়। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩০২ ধারায় মামলা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিদ্যমান সাজা বহাল রাখায় হতাশা প্রকাশ করেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী নাগরিক সমাজের নেতা কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘সাজার মেয়াদ বাড়ানোর স্পষ্ট সুপারিশ ছিল। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেই চালকের ১৪ বছর জেল চাই না। আমাদের দাবি, চালকের কারণে যদি প্রাণহানি হয় তবেই যেন তার সাজা হয়। এ কারণে ১০ বছর সাজার সুপারিশ করা হয়েছিল। পথচারীর ভুলে বা সড়কের কারণে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তবে যেন চালকের সাজা না হয়।’ তবে সর্বোচ্চ সাজা মাত্র তিন বছর বিধান বহাল রাখায়, দুর্ঘটনা আরও বাড়বে বলে মনে করেন আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ সাজাই তো মাত্র তিন বছর। আদালত তো আরও কম সাজাও দিতে পারেন। সাজার পরিমাণ বেশি থাকলে চালক ভয়ে থাকতেন। সাবধানে গাড়ি চালাতেন।’
খসড়ার ওপর স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ করতে গত ১০ এপ্রিল কর্মশালার আয়োজন করে বিআরটিএ। এতে সহায়তা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কর্মশালায় বলেছিলেন, ‘চালকদের জন্য বড় ধরনের শাস্তির বিধান রেখে আইন করা উচিত। শাস্তি কম রাখলে চালকদের অপরাধ কমবে না।’
তবে সুপারিশমালায় মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়নি। আবুল মকসুদ বলেন, ‘বিদ্যমান সাজা বহাল রাখার সুপারিশ করে মন্ত্রীর কথাও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। কায়েমী গোষ্ঠীর চাপের কারণে সাজা বাড়ানো হয়নি। অতীতেও তারা যাত্রীদের জিম্মি করে লঘুদণ্ড বহাল রাখার দাবি করেছিল।’
বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে প্রাণহানি ঘটালে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার দাবিতে ২০১৩ সালে শহীদ মিনারে অবস্থান নেয় নাগরিক সমাজ। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে নৌপরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ধর্মঘটের ডাক দেয়। বিদ্যমান সাজা বহাল রাখার দাবি জানায়, মালিক ও শ্রমিকদের অন্যান্য সংগঠনও।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘যদি তিন বছর সাজা বহাল রাখা হয়, তবে আমাদের আবার আন্দোলনে নামতে হবে।’ সূত্র: সমকাল।
Discussion about this post