নদী পর্যবেক্ষনে গিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে । গন্তব্য ছিল গাজীপুরের শ্রীপুরের গোসিঙ্গা হতে শীতলক্ষার ধাঁধাচরে । পর্যবেক্ষনে গিয়ে নদী হারিয়ে যাওয়ার যে কারণ গুলো সামনে চলে আসলো তা খুব কমন বিষয়গুলো । যেমন নদী দখল, বালু উত্তোলন আর নদীতে ময়লা ফেলার কারণে নদী দূষণ । কিন্তু এই কমন কারণগুলো কিভাবে আজ কমন হয়ে উঠল তা কিন্তু জানার বিষয় । ধরুন রাস্তায় কোন একটি মূল্যবান বস্তু পড়ে আছে এখন আপনি কি করবেন ? যদি স্বর্ণ হয় তবে ওটা দেখার পর স্বর্ণকারের এক ধরণের চিন্তা হবে এবং সাধারণ কোন মানুষের চিন্তা হবে আরেক রকম । সাধারণের চিন্তার মধ্যে যারা ভালো তারা চিন্তা করবে দেখি এর মালিক পাওয়া যায় কিনা অথবা কোথাও এটা জমা রাখা যায় কিনা । কিন্তু গরল মানুষেরা ? হ্যা তারা প্রথমেই চিন্তা করবে এই স্বর্ণটি আগে বিক্রি করবে ও টাকা নেবে ।
এই পড়ে থাকা জিনিসটির প্রতি ব্যবসায়ীর দৃষ্টি একরকম, চাকুরিজীবি মানুষের এক রকম এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টি হল আরেক রকম ! অসৎ ব্যবসায়ী যিনি আছেন তিনি ধরেই নিয়েছেন এটি দিয়ে নতুন একটা পণ্য তৈরী করে তা বিক্রি করবে এবং অন্যান্যরা নিজেরা নিজেদের মত করে ভেবে চলেছেন !
নদীর ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম । নদী আছে ময়লা ফেলা হবে এখানেই । পানির নিচের জায়গা দখল করলে দোষ নেই এবং বালি আছে নদী বালি তুললে সমস্যা নেই ! এভাবেই নষ্ট করে দিচ্ছে নদীপথ, নাব্যতা আর নদীময় বাংলাদেশের অপরুপ রুপ !
একসময় বাংলাদেশে ১২শ’ চলমান নদীর নাম পাওয়া যেত আর এখন ? ২০০ টি নদী বা তার কিছু বেশী নদী পাওয়া গেলেও শীতকালে দেখা যায় বেশিরভাগই নাব্যতাহীন । অসাধারণ সুন্দর সুন্দর নামের নদীগুলো এখন মরা প্রায় । নাম পাগল করা নদীর মধ্যে কিছু নদীর নাম খুব সুন্দর । যেমন ডাহুক নদী, দুধকুমার নদী, চিত্রা নদী, সুগন্ধা নদী, বাঙালি নদী, সুই নদী, ডাকাতিয়া নদী, ময়ুর নদী । এই নামগুলোর মতই আরও অনেক নদী রয়েছে যেগুলো নাম দিয়েই একেকটি প্রেম কাহিনী হয়ে গিয়েছে ইতহাসে । কিন্তু সকল সুন্দর নদীর নামের আগে যোগ হয়ে যাচ্ছে মরা নদী ! দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের । নদী যেখানে আমাদের আবৃত করে ব-দ্বীপের আকৃতি দিয়েছিল এখন সে আকৃতিও হুমকির মুখে । নদী বাঁচাবো নাকি নদী বিষয়ক মানুষের কর্ম নিয়ে হতাশ হবো ? নদীকৃত্য দিবস পালনের খুব কাছাকাছি সময়ে যে লিখাটি লিখছি তা যেন হতাশারই প্রতিচ্ছবি একটি । নদীর মৃত্যুর জন্য যে দায়গুলো দেওয়া হয় তারমধ্যে বড় দায় হল নদীর চলাচলেও বাঁধ । তিস্তা পানি বন্টন না হওয়ায় তিস্তার করুণ পরিনতি দেখেই যেতে হচ্ছে আমাদের । নদী সম্পর্কে দায়িত্বগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এবারও 14 ই মার্চ পালিত হবে নদী কৃত্য দিবস । ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিয়া শহরে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সেই থেকেই চলছে আন্তর্জাতিক ভাবে এই দিবস পালন । ব্রাজিলের সেই সমাবেশে ২০টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। মূলত বিভিন্ন দেশের নদীতে বাঁধের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার শিকার জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিরা সেই সামাবেশে নিজেদের সংকট বিষয়ে আলোচনা ও সমাধানের উপায় খুঁজতে একত্রিত হয়েছিলেন। ওই সমাবেশে ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশের প্রতিনিধিরা নদীর প্রতি জবাবদিহি করার একটি দিবস পালনে একমত হন । তবে আমাদের দেশে এই দিবস পালনের আগে সমস্বরে জানাতে হবে আসলে আমরা নদী নিয়ে কি করতে চাই ।অনেকগুলো সংগঠন নদী নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে নদী পরিব্রাজক দল নদী নিয়ে ভালো কিছু কাজ করছে এবং তা অনেক ক্ষেত্রে ফলপ্রসুও ।
নদী বাঁচাতে হলে সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে এবং মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি নদী আইন অনুযায়ী নদী সুরক্ষার সাথে যারা বিপরীত কাজ করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে দ্রুত । সমস্যা চিহ্নিত পূর্বক কাজ না করতে পারলে যে নদীর কারণে আমরা সুখী দেশ হিসেবে গর্ব করতে পারি সেই নদীর কারণেই দুঃখী দেশ হিসেবে গন্য হবো এক সময় । স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে নদী দূষনের কারণেই । অদেখা এ সমস্যাগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে এখনই । যে এলাকাগুলোতে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে পানিতে সঠিক মাত্রার উপাদানের কমতি দেখা দিচ্ছে দ্রুত, আর্সেনিক বেড়ে যাবে একসময় ভূগর্ভস্থ্য পানিতে আর এ দায় পড়বে পুরো দেশের মানুষের স্বাস্থের উপর ।
আসুন এবার নদীকৃত্য দিবসে সরকারের কাছে একটি দাবীই জানাই নদী বাঁচাতে হবে এবং তা একটি দিবসকে উপলক্ষ করে নয় । প্রতিদিন পরিকল্পনা প্রতিদিন কাজ এটাই হবে বড় স্লোগান নদী রক্ষায় । সুস্থ জাতির জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ পানি ব্যবস্থা আর সুষ্ঠ পানি ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ নদী ব্যবস্থাপনা ।
Discussion about this post