রোকেয়া রহমান
গত বছর বাড়িতে আমি একজন কাজের লোক রাখি। তাঁর নাম ছিল ফিরোজা বেগম। তাঁর দায়িত্ব ছিল শুধু রান্নাবান্না করা। তাঁর একটা মাসিক বেতন ঠিক করা হলো। ফিরোজা বেগমের প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসা। আগে কখনো কোনো বাসাবাড়িতে কাজ করেননি। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসার সময় জানতে পারেন তাঁকে রান্নার কাজ করতে হবে। এতে তিনি বিস্মিত হন যে রান্না করার জন্য আবার কাউকে টাকা দেওয়া হয় নাকি? অন্য কোনো কাজ হলে না হয় কথা ছিল।
এমন চিন্তার জন্য ফিরোজা বেগমকে দোষ দেওয়া যায় না। দেশের সিংহভাগ মানুষই এমনটি মনে করে থাকে। বিশেষ করে রান্নার মানুষটি যদি হয় ঘরের বউ বা মেয়ে। পেশাদার রাঁধুনির যদিও-বা বেতন আছে, ঘরের বউ বা মেয়েটির কোনো বেতন নেই। আমার এক পরিচিত নারী ঘরে ছেলের বউ আসার পর বাঁধা গৃহকর্মীটিকে বাদ দেন আর পরিচিতজনদের কাছে বলতে থাকেন, যাকগে, মাসে অনেক কটি টাকা বাঁচল।
নারীরা শুধু রান্নাই করেন না, সন্তান লালনপালন থেকে শুরু করে ঘর-গেরস্থালির আরও অনেক কাজই করেন, যা অনেকেরই চোখে পড়ে না। আর এসব কাজের কোনো স্বীকৃতিও নেই।
একটা সময় ছিল নারীরা ঘরেই থাকতেন। বাইরে গিয়ে কাজ করার চল ছিল না। ঘরের যাবতীয় কাজ তাই নারীরাই করতেন। কিন্তু সময় পাল্টেছে। নারীরা বাইরে গিয়ে কাজ করছেন। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর কাজের অবদান অনেক। অনেক নারী আছেন যাঁরা বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করার পাশাপাশি ঘরের অনেক কাজ করেন। কিন্তু সেগুলোর কোনো মূল্যায়ন হয় না।
২০১৪ সালে প্রকাশিত বিবিএসের ‘সময় ব্যবহার’ জরিপে দেখা যায়, কর্মজীবী একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন ৫ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট এবং ঘরের কাজ করেন গড়ে ১ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। সে তুলনায় নারীরা অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন ৫ ঘণ্টা ১২ মিনিট এবং গৃহস্থালির কাজ করেন ৩ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট; যার কোনো অর্থমূল্য নেই। অথচ নারীর মজুরিবিহীন ঘর-গেরস্থালির আয়ের পরিমাণ চলতি বাজারমূল্যে বছরে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি থেকে ১১ লাখ ৭৮ হাজার ২ কোটি টাকা। নারীর ঘর-গেরস্থালির কাজের মূল্য দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে যুক্ত হয় না এবং এর কোনো স্বীকৃতিও নেই।
২০১৪ সালে উন্নয়ননীতি-বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী, গৃহিণীদের কাজ পরিবারগুলো যদি বেতনভুক্ত কর্মীদের দিয়ে করাত তাহলে বছরে ১১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতো, যা জিডিপির ৮৭ শতাংশের সমান।
জরিপে দেখা গেছে, গৃহিণীরা যেসব দৈনন্দিন কাজ করেন, সেসব কাজের প্রাক্কলিত বার্ষিক মূল্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জিডিপির ৭৭ শতাংশের সমপরিমাণ। জরিপটি কাজের ছায়া মূল্য ধরে প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে নিরূপণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ঘরের কাজটি ওই নারী নিজে না করে অন্য কাউকে দিয়ে করালে তার আর্থিক মূল্য হতো জিডিপির ৭৭ শতাংশের সমপরিমাণ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৫০৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এর ৭৭ শতাংশে আসে ১০ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। আর গ্রহণযোগ্য মূল্য পদ্ধতিতে এর প্রাক্কলিত বার্ষিক মূল্য জিডিপির ৮৭ শতাংশের সমপরিমাণ। অর্থাৎ অন্য কাউকে দিয়ে না করিয়ে বা অন্য কোথাও চাকরি না করে ঘরের কাজটি নিজেই করলে সেটির আর্থিক মূল্য দাঁড়াত ১১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব নারী নিজের সংসারের ঘর-গেরস্থালির কাজে নিয়োজিত, তাঁরা স্বামীর কাছ থেকে বেতন প্রত্যাশা করেন কি না?
আমি আমার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর দীর্ঘ ৫৭ বছরের সংসারজীবনে তিনি কখনো তাঁর কাজের জন্য বাবার কাছ থেকে বেতন পেয়েছিলেন কি না বা চেয়েছিলেন কি না। শুনেই কেমন আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘তাই কি হয়? আমি কি কাজের লোক যে বেতন নেব? এ তো আমার নিজের সংসার।’
একই প্রশ্ন রেখেছিলাম আমার এক ‘বেকার’ বান্ধবীর কাছে (যে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সংসারের কাজ শুরু করে। শেষ করে রাত ১২টায়)। বান্ধবীটির উত্তর ছিল প্রায় আমার মায়ের উত্তরের মতোই। বলে, ‘সবই তো করি নিজের সংসারের জন্য। এ জন্য স্বামীর কাছ থেকে আলাদাভাবে টাকা চাইব কীভাবে। হাতখরচ পেলেই আমি খুশি। তবে আরও বেশি খুশি হতাম যদি আমার স্বামী ঘরের কিছু কাজ করে দিত।’
বান্ধবীর এই উত্তর শুনে আমার এক পরিচিত ব্যক্তির (যিনি অনেক বড় চাকুরে ও উদারমনা বলে পরিচিত) কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ঘর-গেরস্থালির কাজ করার জন্য তিনি তাঁর স্ত্রীকে সাহায্য করেন কি না। জবাবে তিনি বললেন, এ আবার কেমন কথা! আমি বাইরেও কাজ করব আবার ঘরের কাজও করব। তাহলে আমার বউয়ের কাজটা কী? তারপর তিনি আমার মাথা ঠিক আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
অর্থাৎ অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে আমাদের দেশের নারী ও পুরুষ উভয়ই মনে করছেন ঘরের কাজটা কেবল নারীরই। পুরুষেরা ঘরের কাজ করবেন না। তবে কোনো পুরুষই যে ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করেন না, তা নয়। অনেক পুরুষই করেন। তবে তাঁদের সংখ্যা নগণ্য। তাই ঘর-গৃহস্থালির কাজ ও সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব শুধু নারীর—এ ধারণা পাল্টাতে হবে। পুরুষকেও ঘরের কাজে ও সন্তান লালনপালনে নারীর সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক।
Discussion about this post