একজন নারীকে পারতপক্ষে কারাগারে নিতে চায় না আদালত, যতক্ষণ না তিনি কোনো কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হন। কারাগার কিংবা পুলিশি হেফাজতে নারীকে নেয়ার ক্ষেত্রে আইন সব সময় সর্বোচ্চ পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বনের তাগাদা দেয়, তাদের বিশেষ সুরক্ষা প্রদানের কথা বলে। কিন্তু তারপরও কারাগারগুলোতে নারী বন্দি ও নারী হাজতিদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত ।
পারুল আক্তার (ছদ্মনাম) দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে একটি বিভাগীয় সদরের নিম্ন আদালতে শিক্ষানবিস আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। একদিন রাতে হঠাৎ করে কিছু থানা পুলিশ তার বাড়িতে এসে তাকে ওয়ারেন্টমূলে গ্রেপ্তার করে এবং বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক কারাগারেও প্রেরণ করে। পরে তিনি জানতে পারেন যে জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের জেরে একটি মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনদিন কারাগারে হাজত বাসের পর তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। কিন্তু সেই তিনদিন তার জীবন থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে প্রেরণ এবং সেখান থেকে কারাগারে প্রেরণের সময় থেকে জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত ও স্থানে তাকে মোকাবেলা করতে হয় বিভিন্নরকম হয়রানি ও খারাপ পরিস্থিতির। সম্মুখীন হতে হয় হাজারো বাজে অভিজ্ঞতার। শুধু পারুল আক্তার নয়, তার মতো হাজারো নারী কারাবন্দি কারাগারগুলোয় প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে এরকম হয়রানি ও বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছে।
সমগ্র বাংলাদেশ অবস্থিত ৬৮টি কারাগারই নানা সমস্যায় জর্জরিত। কারাগার ও কারাবন্দিদের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকার সবসময় বেশ উদাসীন। ব্রিটিশ আমলে তৈরি অধিকাংশ কারাগারেই সেল ও ওয়ার্ডগুলো খুব ছোট ছোট, পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা দুর্বল এবং বাতাস চলাচলের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। অধিকাংশ কারাগারে সারা বছর ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বন্দিদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। তাছাড়া নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার অভাব, অপরাধপ্রবণতা, বিভিন্ন ধরনের রোগ-জীবাণু বিস্তার, সহবন্দিদের দ্বারা হয়রানি ইত্যাদি বিষয়গুলো বাংলাদেশের কারাব্যবস্থাপনাকে ভঙ্গুর করে তুলেছে।
কারাগারগুলোয় নারী কারাবন্দিরা পুরুষের তুলনায় আরো বেশি মাত্রায় সমস্যার সম্মুখীন হন। নারী কারাবন্দিদের জন্য শুধু পৃথক সেলের অপর্যাপ্ততায় নয়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া নারী কারাবন্দিসহ মায়েদের সঙ্গে অবস্থানরত শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সঠিক পরিমাণে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতাসহ শিশুদের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধাদি এসব কারাগারে নেই।
কারাবিধির ১২৯ ধারা কারাবন্দিদের ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দের কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবে অতিরিক্ত কারাবন্দির অবস্থান যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশিমপুর মহিলা কারাগারসহ সমগ্র দেশের কারাগারগুলোয় ২৩০০ জন নারী কারাবন্দির অবস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৩০০০ জনেরও বেশি নারী কারাবন্দি অবস্থান করছে। যার মধ্যে অধিকাংশই বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে।
তাছাড়া অধিকাংশ নারী কারাবন্দিদের সঙ্গে রয়েছে তাদের শিশুসন্তান, যার সংখ্যা এ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নারী কারাবন্দিদের সঙ্গে অবস্থানরত শিশুসন্তানদের সংখ্যা যোগ করলে তা যে বর্তমান সংখ্যার চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কারাগারে নারী কারাবন্দিদের তাদের শিশুসন্তানের সঙ্গে একত্রে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়। অনেক সময় পালাক্রমে ঘুমাতে হয় এবং এমনকি কিছু কিছু সময় ঘুমানোর সুযোগও মেলে না। ফলে এমন অমানবিক বাসস্থানের পরিস্থিতি শুধু নারী কারাবন্দিদের নয়, তাদের সঙ্গে অবস্থানরত শিশুসন্তানের বেড়ে ওঠার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কারাবিধি অনুযায়ী একজন কারাবন্দি প্রতিদিন ১৩৩.২৮ গ্রাম সবজি, ৭২.৯০ গ্রাম মাছ বা ৭৭.৯০ গ্রাম মাংস এবং ১৪৫.৮০ গ্রাম ডাল পাওয়ার অধিকারী হলেও কিছু অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেক কম পরিমাণ খাবার সরবরাহ করে, যা তাদের প্রতিদিনের চাহিদা মেটানোর জন্য খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া যে খাবার সরবরাহ করা হয় তা খুবই নিম্নমানের। যদিও কারাবিধি অনুযায়ী কারাবন্দিদের বাইরে থেকে খাদ্য সরবরাহ করা নিষিদ্ধ, তারপরও কিছু অসাধু কারাকর্মকর্তার যোগসাজশে অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তা করা হয়। এমনকি অবৈধ অর্থ প্রদান করলে ভালো খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়।
কারাগারগুলোয় চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয় না বললেই চলে। যেটুকু প্রদান করা হয় তা খুবই নামেমাত্র আর প্রাথমিক পর্যায়ের। প্রয়োজনীয় ওষুধের অপর্যাপ্ত সরবরাহ, সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের অভাব, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দুর্নীতি কারাগারে স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে অবনতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অধিকাংশ অসুস্থ কারাবন্দির চিকিৎসাসেবা পেতে খুব ঝামেলা পোহাতে হলেও বিত্তশালীরা খুব সহজেই অসুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও কারাহাসপাতালের ওয়ার্ডে অবস্থান করার সুযোগ পায়।
কারাবিধির ৯৪ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক কারাগারে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা দেখা যায় না। যা খুবই উদ্বেগজনক। তাছাড়া গর্ভবতী কারাবন্দিদের মাসে দুবার করে শারীরিক পরীক্ষা করার কথা কারাবিধিতে থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।
জীবাণুমুক্ত খাবারপানি কারাগারগুলোয় নারী কারাবন্দিদের জন্য যেন অলীক স্বপ্ন। অন্যান্য কারাবন্দির মতো তাদেরও পাইপলাইনে সরবরাহকৃত সাধারণ পানি পান করতে হয়, যে পানি সাধারণত প্রাতঃকার্য শেষে ব্যবহার করা হয়। তদুপরি, স্যানিটারি ও ড্রেনেজব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। নারী কারাবন্দিদের জন্য পৃথক টয়লেটের অপর্যাপ্ততার কারণে দীর্ঘ লাইন দিয়ে প্রাতঃকার্য সম্পন্ন করতে হয়। টয়লেটগুলো প্রতিদিন নামেমাত্র পরিষ্কার করা হলেও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অধিকাংশ সময় অস্বাস্থ্যকর ও ব্যবহার অনুপযোগী থেকে যায়।
সর্বোপরি, নারী কারা ইউনিট নারী কারারক্ষীদের দ্বারা পরিচালনা করার কথা থাকলেও বাস্তবে নারী কারারক্ষীর স্বল্পতার কারণে তা করা হয় না। ফলে কারাগারে অবস্থানরত নারী কারাবন্দিরা নিয়মিত পুরুষ কারারক্ষীদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়, যা তারা প্রকাশ করতে সাহস পায় না। কারণ প্রকাশ করলে তাদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি।
সরকার নারী কারাবন্দিদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশেষ করে কারাকর্তৃপক্ষের সীমাহীন দুর্নীতি ও নারী কারাবন্দিদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান না দেখানোর মনোভাবের কারণে আজো কারাগারে নারী কারাবন্দিরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। নারী কারাবন্দিদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার নূ্যনতম সুযোগ সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন তাই সময়ের দাবি।
লেখক : তরুণ ও উদীয়মান মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে (ইউএনডিপি) কর্মরত।
Discussion about this post