বিডি ল নিউজঃ ধর্ষণ করে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড ছাড়া বিকল্প শাস্তির বিধান না রেখে প্রণীত ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন সংশোধনের পর আগের মামলাগুলো পুরনো আইনে চালানোর বৈধতা দিয়ে ২০০০ সালের আইনে যুক্ত একটি ধারা (৩৪ এর ২) সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় এসেছে সর্বোচ্চ আদালত থেকে। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল ও পৃথক আবেদন নিষ্পত্তি করে মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ এ রায় ঘোষণা করেন।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ধর্ষণের শাস্তি সংক্রান্ত ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬ (২), ( ৩) ও (৪) ধারাও শাসনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, ১৯৯৫ সালের আইনে বিচারাধীন মামলাগুলোর ভবিষ্যত এখন কী হবে, তা আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর জানা যাবে।
ওই তিনটি ধারায় সাজা হিসাবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হলেও ৬(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার দায়ে কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল।
তবে ২০০০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আইনটি রহিত করা হয়। নতুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।
১৯৯৫ সনের ওই আইনের রহিতকরণ ও হেফাজত সম্পর্কে ২০০০ সালের ওই আইনের ৩৪(২) ধারায় বলা হয়, ‘উক্তরূপ রহিতকরণের অব্যবহিত পূর্বে উক্ত আইনের অধীন অনিষ্পন্ন মামলা সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে এবং অনুরূপ মামলায় প্রদত্ত আদেশ, রায় বা শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল সংশ্লিষ্ট আদালতে এমনভাবে পরিচালিত ও নিষ্পত্তি হইবে যেন উক্ত আইন রহিত করা হয় নাই৷”
এই ধারাটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে এখন সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দিল।
যে ঘটনা নিয়ে
আইন প্রণয়নের পরের বছরের এক ঘটনায় ২০০১ সালে দেওয়া সাজার আদেশকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় এসেছে।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার শিবরামপুর গ্রামে শুকুর আলী নামে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করে।
২০০১ সালের ১২ জুলাই বিচারিক আদালত শুকুর আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
পরের বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগেও সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। শুকুর আলী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ওই বছরের ৪ মে তাও খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।
হাই কোর্টে রিট আবেদন
এরপর শুকুর আলী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ২০০৫ সালের নভেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।
২০১০ সালের ২ মার্চ হাই কোর্ট ৬ (২) ধারা সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে। তবে আপিল বিভাগে শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় হাই কোর্ট তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
পাশাপাশি শুকুর আলীর দণ্ড কার্যকর স্থগিত করে সরাসরি আপিল করার সনদ দেয় আদালত।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল আবারও আপিল বিভাগে আসেন শুকুর ও ব্লাস্ট। এছাড়া ওই আইনে সাজাপ্রাপ্ত আরও ১১টি আবেদনও শুনানির জন্য আসে।
শুনানি শেষে আপিল বিভাগ বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। মঙ্গলবার সকালে আদালত রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে আবেদনকারী পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী শুনানি করেন। তাকে সহায়তা করেন আইনজীবী এ বি এম বায়েজীদ, আবদুল মান্নান খান ও নাজনীন নাহার দিপু। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
প্রতিক্রিয়া
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি বিধান ছিল, কেউ যদি কোনো নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটায়, তার সাজা মৃত্যুদণ্ড হবে। এই বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে একটি মামলা শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগে গিয়েছিল। এটি শুকুর আলীর মামলা বলে খ্যাত।
“এর সঙ্গে কতগুলো জেল পিটিশনও ছিল। এগুলোরও রায় হয়েছে। আপিল বিভাগ ৬(২),(৩) ও (৪) বিধানটি সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন। এই আইনটি সংশোধন করে ২০০০ সালে যে নতুন আইন করা হয়েছে, সে আইনের ৩৪ (২) বিধানটি অবৈধ ঘোষণা করেছে।”
মাহবুবে আলম বলেন, “এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়টি পেলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে আদালত কোন বিধান অবৈধ ঘোষণা করেছেন, কোনগুলোর ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, কোন কোন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন, কোন কোন আসামির কারাদণ্ডকে যাবজ্জীবনে রূপান্তর করেছেন।”
তবে যারা আগের আইনে অপরাধ করেছে, বর্তমান আইনে তাদের বিচার হতে বাধা নেই বলে মনে করেন রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কমকর্তা।
তবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী বিডিনিউজ টেয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৯৫ সালের আইনের মামলাগুলো আপাতত ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে। মামলাগুলো কিভাবে চলবে ও এর ভবিষ্যত কী হবে, তা আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে জানা যাবে।
আপিলকারীপক্ষের অন্য আইনজীবী আবদুল মান্নান খান বলেন, যতটুকু জানি শুকুর আলী কাশিমপুর কারাগারে আছেন। হাই কোর্ট শুকুর আলীর দণ্ড কাযকর স্থগিত করে, পরে আপিল বিভাগও স্থগিতাদেশ দেয়।
“আপিল মঞ্জুর হয়েছে। আদালত বলেছেন, একজনের দণ্ড কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ধারণা করছি, শুকুর আলীর সাজা হয়ত কমানো হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় পেলেই এ বিষয়ে জানা যাবে।”
১৯৯৫ সালের আইনে সংশ্লিষ্ট ধারা
ধর্ষণের শাস্তি সংক্রান্ত ৬(২) ধারা অনুসারে, যদি কোনো ব্যক্তি ধর্ষণ করে কোনো শিশু অথবা নারীর মৃত্যু ঘটান বা ধর্ষণ করার পর কোনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটান, তা হলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
৬ (৩) ধারায় অনুসারে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো শিশুকে বা নারীকে ধর্ষণ করেন, তা হলে ওইসব ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৬ (৪) ধারায় বলা হয়, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে কোনো শিশু অথবা নারীর মৃত্যু ঘটান বা ধর্ষণ করার পর কেনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটান তাহলে ওইসব ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সূত্রঃ বিডি নিউজ ২৪
Discussion about this post