নিম্ন আদালতের ৪৯ বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়ম, বিচারিক অসততা, স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত ঝুলে আছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ বিচারক বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত আছেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকাকালে এসব কর্মকর্তা ‘জুডিসিয়াল অফেন্সে’ জড়িয়ে পড়েন।
জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ৫৪ বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের জিএ (জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ) কমিটি আইন মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয় এবং তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে। মন্ত্রণালয় অদ্যাবধি তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টকে কিছু জানায়নি। ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত এই অভিযোগগুলো মন্ত্রণালয়ে ঝুলে আছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের ভিত্তিতে তারা তদন্তকাজ অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। সেই কমিটির কিছু তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর কয়েকজন বিচারকের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে অধিকাংশ অভিযোগের
বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, ‘সব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শেষ হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।’ বিষয়টি নিয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৫৪ বিচারকের মধ্যে চারজনকে ইতিমধ্যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একজনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। অবশিষ্ট ৪৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে তদন্তাধীন। তবে এই তদন্ত চলছে ধীরগতিতে।
জানা যায়, অব্যাহতিপ্রাপ্ত চারজন হলেন মাদারীপুরের সাবেক জেলা জজ মো. আতাউর রহমান, ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (জেলা জজ) মো. আরিফুর রহমান, খাগড়াছড়ির চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আসাদুজ্জামান খান ও যুগ্ম জেলা জজ রিপতি কুমার বিশ্বাস। ছয় বিচারক বিদেশ গিয়ে আর ফেরেননি। তারা হলেন- সিনিয়র সহকারী জজ মোহাম্মদ শরীফ হোসেন, আয়েশা সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ এমদুল্লাহ, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও মোসাম্মৎ আরিফুন্নাহার। তদন্ত এড়াতে তিন বিচারক স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন। তারা হলেন যুগ্ম জেলা জজ মেহতাজ বিনতে হামিদ, সিনিয়র সহকারী জজ আকবর আলী খান ও মো. আবদুল মতিন। বিচারক মো. নূর আলী ও মো. আবুল হোসেন খন্দকার উচ্চ আদালতে রিট মামলা করায় তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া যুগ্ম জেলা জজ মো. মামুনুর রশীদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে কোনো তথ্য নেই।
যাদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে, তারা হলেন- দিনাজপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শেখ মো. আখতার উল আলম, কক্সবাজারের সাবেক মুখ্য বিচারিক হাকিম সৈয়দ হুমায়ুন আজাদ, কক্সবাজারের সাবেক জেলা জজ মো. মোক্তার আহমেদ ও চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ তৌফিক আজিজ, কুষ্টিয়ার সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ টি এম মুসা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাবেক মুখ্য বিচারিক হাকিম এ কে এম মোস্তাকিনুর রহমান, চাঁদপুর জেলা ও দায়রা জজ মফিজুল ইসলাম, ভোলার জেলা ও দায়রা জজ ফেরদৌস আহমেদ, ঢাকার সাবেক বিশেষ জজ রেজাউল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গার জেলা জজ শিরিন কবিতা আক্তার, নীলফামারীর জেলা জজ মাহমুদুল কবির, খুলনা জেলার সাবেক অতিরিক্ত জজ মঈনুল হক, ফরিদপুরের বিশেষ জজ এ এস এম জহুরুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক যুগ্ম জজ মো. আল-মামুন, কক্সবাজারের সাবেক জেলা জজ মো. সাদিকুল ইসলাম তালুকদার, কুড়িগ্রাম জেলার সাবেক সিজেএম মো. রেজাউল করিম সরকার, ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ মো. জুয়েল রানা (তার বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগের তদন্ত চলছে) ও রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) গোলাম আহমেদ খলিলুর রহমান। এ ছাড়া সাত যুগ্ম জেলা জজ হলেন- সাইফুর রহমান সিদ্দিকী, শেখ রাজিয়া সুলতানা, মাকসুদুর রহমান, মো. মাহবুবুর রহমান, রিপতি কুমার বিশ্বাস, মো. আশরাফুজ্জামান জিলানী ও অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম নুরুল আলম মোহাম্মদ নিপু। ১১ সিনিয়র সহকারী জজ হলেন- মাহবুব আলী মুয়াদ, মো. তাজউল ইসলাম, মো. জাভেদ ইমাম, সুব্রত কুমার মলি্লক, আ. বা. মো. নাহিদুজ্জামান, আবদুল্লাহ আল মাসুম, সাইফুল ইলাহী, মুক্তা পারভীন, মোহাম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ এনামুল হক বসুনিয়া ও ফরিদ আলম।
জানা যায়, অধিকাংশ তদন্ত কমিটি দীর্ঘদিনেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করায় এসব বিচারকের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
হাইকোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) মো. সাব্বির ফয়েজ গণমাধ্যমকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যেসব বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সুপারিশ করেছেন, তাদের সব নথি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, অভিযুক্ত বিচারকদের অনেকের ব্যাপারে তদন্ত শেষ হয়েছে।
৪৯ বিচারকের মধ্যে একাধিকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের অধিকাংশই তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র: সমকাল
Discussion about this post