দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রধান কেন্দ্র ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’-এর নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ। কোর্টের তিন প্রবেশ গেটে যথাযথ তল্লাশি করা হয় না। ৮৪টি সিসিটিভি থাকলেও এগুলো তদারকিতে পর্যাপ্ত জনবল নেই। এছাড়া, কেপিআইয়ের আদর্শ অনুযায়ী সীমানা প্রাচীর অনুপস্থিত। সুপ্রিম কোর্টের সীমানা প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ ১১টি ভবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের শীর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা গেল সপ্তাহের শেষদিকে সুপ্রিম কোর্ট-এর সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে এভাবেই মূল্যায়ন করেছে। বিষয়টি সম্পর্কে এ ভাবেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন তারা। ওই প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা পুনর্মূল্যায়ন করার অনুরোধ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে।
সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ঝুঁকি মূল্যায়ন শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা ঝুঁকি পর্যালোচনা বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ/মহড়া অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া, সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশ/বের হওয়ার জন্য উন্মুক্ত ৩টি ফটকে প্রবেশ/বের হওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ তল্লাশি করা হয় না। পুরো কোর্ট এলাকায় ৮৪টি সিসিটিভি স্থাপন করা হলেও এগুলোর তদারকিতে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। চারটি আর্চওয়ে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ/তদারকি হচ্ছে না। এছাড়া, কোর্ট প্রাঙ্গণে একটি কুরিয়ার অফিস, ব্যাংক ও লন্ড্রিসহ অনেক দোকান থাকলেও এগুলোতে আনা বা এগুলো থেকে বের করা দ্রব্যাদি তল্লাশি করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই।
বিশেষ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, একটি কেপিআই-এর আদর্শ অনুযায়ী যে মানের সীমানা প্রাচীর থাকা দরকার সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। অধিকন্তু সুপ্রিম কোর্টের চারপাশে বিদ্যমান সুবিস্তৃত সীমানা প্রাচীর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। সুপ্রিম কোর্টের প্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে কাঁটাতার তুলে ফেলে বহিরাগত লোকজনের আসা-যাওয়া করতে দেখা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল কোর্ট ভবনে অবস্থিত প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের পশ্চিমে টিনশেড ঘরগুলোতে ৪ জন ২য় শ্রেণির কোর্ট অফিসারসহ ১১৭ জন ৩য়/৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী সপরিবারে বসবাস করছেন। এছাড়া, এনেক্স ভবনের উত্তর দিকে ৪টি টিনের ঘরে পিডব্লিউডি’র কয়েকজন ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী সপরিবারে বসবাস করছে। এসব টিনশেড ঘরগুলো অরক্ষিত বলে বহিরাগত লোকজন অনায়াসে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে। সুপ্রিম কোর্টের ২ নং এনেক্স ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে সুপরিসর কার পার্কিং এলাকা থাকলেও তা ব্যবহার করা হয় না। ওই জায়গাটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ভুতুড়ে পরিবেশের মতো পড়ে থাকে।
গোয়েন্দা সংস্থার এই বিশেষ প্রতিবেদনে সুপারিশ আকারে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের চারপাশে অরক্ষিত সীমানা প্রাচীর, নিরাপত্তা সদস্যের স্বল্পতা, স্ক্যানার ও আর্চওয়েসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। এছাড়া, সিসিটিভি ক্যামেরা তদারকি করার মতো দক্ষ জনবলের অভাবের কারণে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। এ ঝুঁকিকে মোকাবিলা করতে সুপারিশ আকারে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টে প্রতিদিন নানা উদ্দেশ্যে প্রচুর লোকজন গমনাগমন করে, যা নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাধারণ দর্শনার্থীদের যথাযথ তল্লাশির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি বিচারক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনজীবী ও তাদের সহকারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচয়পত্র প্রদর্শনের পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পর্যাপ্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন (হাইরেজুলেশন ও জুম ইন ক্যাপাবিলিটিসহ) সিসিটিভি ক্যামেরা ও চেকপোস্ট স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এছাড়া, সিসিটিভি ক্যামেরার কার্যক্ষমতার বিষয়টি নিয়মিতভাবে তদারকি করা যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টিনশেড ঘরগুলোতে বসবাসকারীদের অন্যত্র আবাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কোর্টের পার্কিং সিস্টেম উন্নত করাসহ ২ নং এ্যানেক্স ভবনে অবস্থিত আন্ডার গ্রাউন্ড কার পার্কিং এলাকাটিকে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সব ব্যক্তির সমন্বয়ে নিয়মিতভাবে (মাসিক/ত্রৈমাসকভিত্তিক) মহড়া অনুশীলন এবং প্রয়োজনে বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।
উক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনা। ভৌগোলিক অবস্থান এবং যুদ্ধাপরাধসহ চলমান চাঞ্চল্যকর বিচার কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের সীমানা প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ ১১টি ভবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিচারক, আইনজীবী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাধারণ দর্শনার্থীসহ প্রতিদিন প্রায় ১২/১৩ হাজার লোকের গমনাগমন ঘটে। এরূপ প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করে জোরদার করা প্রয়োজন বলে প্রতীয়মান হয়।
সুপ্রিম কোর্ট এলাকার বর্তমান নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট এলাকার সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো একজন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার তত্ত্বাবধান করেন। কোর্ট প্রাঙ্গণে মোট ৩টি প্রবেশ গেট রয়েছে, যার ২টি (পুরনো সড়ক ভবন ও আইসিটি সংলগ্ন) প্রায়শই বন্ধ থাকে। অপর ফটকে পোশাকধারী ১ জন সশস্ত্র পুলিশসহ ৪ জন নিরস্ত্র পুলিশ ও ২ জন আনসার সদস্য নিয়োজিত থাকেন। কোর্ট এলাকায় একজন পরিদর্শকের তত্ত্বাবধানে ২৪ জন এসবি পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া, বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে প্রয়োজনীয় সংখ্যক র্যাব, এপিবিএন ও পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। আদালত চত্বরে স্থায়ীভাবে একটি পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে, যাতে ১ জন উপ-পরিদর্শকের নেতৃত্বে ৩২ জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। পুরো কোর্ট এলাকায় ৮৪টি সিসিটিভি ও কোর্ট ভবনে ৪টি আর্চওয়ে রয়েছে। এছাড়া আইনজীবী সমিতির নিজস্ব ২৭ জন গার্ড আছে। যারা সার্বক্ষণিক আইনজীবী সমিতির নিজস্ব ভবন ও স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। এত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরও সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশেষ প্রতিবেদনে মত দেয়া হয়েছে।
Discussion about this post