তানভীর চৌধুরীঃ
“প্রচারেই প্রসার”, এই প্রবাদে আমরা অনেকই বিশ্বাসী। বিশেষ করে যখন এর মূল উদ্দেশ্য বা স্বার্থ জনগণের সাথে সম্পৃক্ত। তবে, এই যুগে প্রচারনা ছাড়া কিছু অর্জন করা অনেকটাই অসম্ভবকে সম্ভব করার ন্যায়। যদিও অনেকেই উক্ত প্রবাদকে ‘নিজের ঢোল নিজে পেটানো’ থিওরি বলে থাকে। তাতে অবশ্য কি আসে যায়, যদি নিজের ঢোল নিজে পিটে আপনার পায়দা উঠে, তাহলে লোকের কথায় কান দিয়ে কি লাভ? প্রচারনা শব্দটির সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হই খুব সম্ভবত ধর্মের মাধ্যমে। প্রায় সকল ধর্মের প্রসার কিংবা বিস্তার যাই বলি না কেন তা হয়েছে কোন না কোন প্রচারকের মাধ্যমে। যেমন, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক বা প্রচারক ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ), খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারক যীশু খ্রিস্ট। এই প্রচারকদের প্রচারনার মাধ্যমেই যুগ থেকে শতাব্দী, শতাব্দী থেকে কাল পর্যন্ত ধর্ম অবিচল আমাদের মাঝে বিস্তিত। ধর্মের পর আমরা প্রচারনার বিষয়টি সবচেয়ে বেশী যে মাধ্যমে দেখেছি তা হল ব্যবসা খাতে। প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বা সেবা প্রত্যেকের মাঝে পৌছে দেওয়ার জন্য দিন রাত প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস না হলে একবার টিভি সেটের সামনে দাঁড়ালেই বুঝতে পারবেন বিজ্ঞাপনের নামে কি হারে প্রচারনা চালাচ্ছেন আমাদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলো। মোবাইল কোম্পানি থেকে শুরু করে তেল, সাবান, প্লট, ফ্যাট ইত্যাদি এমনকি মুভির প্রচারনাও এখন সস্তা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, আমাদের আলোচনা এখন প্রচারনা হলেও বিষয়টা ভিন্ন আর তা হল রাজনীতি; অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক প্রচারনা’ তথা নির্বাচনী প্রচারনা।
ধর্ম এবং ব্যবসার প্রচারনার সাথে রাজনৈতিক প্রচারনা কিছুটা পদ্ধতিগত ভিন্নতা রয়েছে। উদ্দেশ্যও অবশ্য অনেকটাই ভিন্ন। ধর্ম প্রচারনার উদ্দেশ্য ধর্ম গ্রহণ করা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা; ব্যবসায়ী প্রচারনার উদ্দেশ্য পণ্য ব্যবহার বা সেবা গ্রহণ কিন্তু রাজনৈতিক প্রচারনার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে সহযোগিতা অর্থাৎ ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করা। আর এই কারনেই শব্দটি রাজনৈতিক প্রচারনা হলেও আমাদের কাছে নির্বাচনী প্রচারনা নামেই বেশ পরিচিত। এর মধ্যে, আমরা সকলেই অবগত যে, আমাদের দেশে প্রত্যেক সরকারই পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন এবং পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পালাবদল হয়। আর ঠিক নির্বাচনের আগ মুহূর্তেই প্রার্থীরা ভোট যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেচে নেওয়া প্রচারনার কাজে পুরো দমে মাঠে নেমে পড়েন। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এখন আমাদের দেশেও রাজনৈতিক বা নির্বাচনী প্রচারনা খুব জমজমাট হচ্ছে।
এটা আসলে সভ্য রাজনীতির প্রতীকও বটে। কেননা, আগে যেখানে ভোটের দিন গণ্ডগোল, ভোট বক্স চুরি, জাল ভোট, ক্ষমতাসীন দলের অপশক্তির প্রয়োগ ইত্যাদি আমরা দেখে এসেছি, সেখানে এখন নির্বাচনী প্রচারনা দিয়ে যার যার ভোট ব্যাংক নিজেরাই তৈরি করছেন। আমাদের দেশে নির্বাচনী প্রচারনার আরও একটি বিশাল উদ্দেশ্য রয়েছে। কেননা, হিসেব করলে দেখা যায়, আমাদের দেশের প্রায় ৭০% ভোটার সমান দুই ভাগে দুইটি প্রধান দলে(১৪ দল ও ১৮ দল) বিভক্ত। অর্থাৎ, প্রায় ৩৫% ভোটার প্রত্যেক দলেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করে। এরা কেউ ঐ দলের কোন নেতাকে ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করে, কেউ সক্রিয় ঐ দলের কর্মী আবার কেউ রয়েছে তার দাদা ঐ দল করত তাই তার বাবা ঐ দল করেছে আর তাই উনিও ঐ দল করেন; যার ব্যক্তিগত কোন পছন্দ নেই, নাকি বিবেকই নেই কে জানে। যাই হোক, আর বাকী ৩০% ভোটার যারা কিনা পাকিস্থানের ভয়ংকর স্পিনার সাঈদ আজমলের দুসরা বলের মত, কখন কোন দিকে এরা টার্ন করবে পূর্বে থেকে বলা মুশকিল।
কেউ কেউ এইসব ভোটারদের সুইং ভোটারও বলে থাকেন। এরাই মূলত একেক সময় একেক দলে ঝুঁকে থাকেন। এরা মূলত একেক সময় একেক দলকে ভোট দিয়ে থাকেন এবং সেই দলই মাশ আল্লাহ্ ঐ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন; যা গত কয়েক নির্বাচনে আপনারাই সচক্ষে দেখেছেন। রাজনীতিবিদদের যত কাঠ গা পোহাতে হয়, তার পুরোটাই এই সুইং ভোটারদের জন্যই। পাঠক হয়তো ভাবছেন, তাহলে তো এদের খুব কদর তাই না? সত্যিই তাদের খুবই কদর। নির্বাচন প্রার্থীরা সুইং ভোটারদের জন্য যে শুধু প্রচারনাই চালান তা কিন্তু নয়, অন্ধকারে বাম হাতের কাজও কম চালান না। এটার জন্য যদিও আমরা শুধু একতরফা রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করি, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ঐ সুইং ভোটাররাও সমান ভাবে দায়ী; যেমন ঘুষ দেওয়া-নেওয়া সমান অপরাধ। তাদের(সুইং ভোটার) চাহিদা রয়েছে বলেই রাজনীতিবিদরা তাদের জন্য টাকা খরচ করছেন, তার ফলশ্রুতিতে ক্ষমতায় আসছেন এবং পরেরটা ওপেন সিক্রেট, আমাদের সকলেরই জানা। যাই হোক, প্রচারনায় আসি। সব দলের নির্বাচনী প্রচারনা প্রায় একই, শুধু ইস্যু এবং মতগত কিছু পার্থক্য রয়েছে।
যে সরকার ক্ষমতা ছাড়ে, তারা মূলত সরকার থাকাকালীন কি কি করেছেন (যেমন দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, বিচার ব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি) তা নিয়েই প্রচারনা চালায়, পাশাপাশি আরও কি কি করতে পারবে আগামীবার আবার ক্ষমতায় আসলে, বিপক্ষের কিছু নিন্দা ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে, বিপক্ষ দল প্রতিনিয়ত সদ্য সমাপ্ত সরকারের সকল ব্যর্থতা তুলে ধরবেন। পাশাপাশি পরবর্তী নির্বাচনে জনগণের ভোটে জয় লাভ করলে জনগণের জন্য কি কি করবেন তার একটি তালিকা পেশ করবেন। এই সব প্রচারনা প্রতিশ্রুতিতে রূপ নেয় এবং তখন তাকে আমরা নির্বাচনী ইশতিহার বলে থাকি। এইসব নির্বাচনী প্রচারনা দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে মাঠে ময়দানে লিখিত-অলিখিত সব রকম ভাবে হতে পারে। তবে, গ্রামের চায়ের দোকানদারদের নির্বাচন পূর্ব মুহূর্তের চা বিক্রির হার থেকে বলা যায়, নির্বাচনী আলোচনার পাশাপাশি প্রচারনাটা চায়ের দোকানেই মনে হয় বেশীই হয়।
আমাদের এই নির্বাচনী প্রচারনায়ও স্যার আইজ্যাক নিউটনের ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে’ এই সূত্রের প্রয়োগ রয়েছে। আর তা হল অপপ্রচার। একদলের দোষ আরেক দলের উপর চাপানোই হচ্ছে প্রধানত অপপ্রচারনারের মূল লক্ষ্য। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শুরু করে বিদেশ থেকে ঋণ না পাওয়া, হত্যা, গুম, চাঁদাবাজি ইত্যাদি প্রতিটি ইস্যুতেই প্রচারনার চেয়ে অপপ্রচারনার হারই বেশী। কেননা, আমরা জাতি হিসেবে নিজেকে বিশুদ্ধ প্রমাণের চেয়ে নিজের প্রতিপক্ষের মুখে চুন কালি মাখতে বেশ উৎসাহী। আর তখনই আমাদের মত সাধারণ জনগণের বুঝা মুশকিল হয়ে যায় যে, এটা কি নির্বাচনী প্রচারনা নাকি প্রতারণা।
Discussion about this post