নাসরীন সুলতানা
নারী স্বাধীনতা, নারীর মর্যাদা বুলি সর্বস্ব একটি শ্লোগান। প্রকৃত পক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী কে সবাই হেয় এবং মূল্যহীন মনে করে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীর নিজস্ব সত্বা বলতে কিছু নেই। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, ঘরে-বাইরে সব স্থানে অবহেলিত মর্যাদাহীন এক প্রাণী মাত্র। হাজারো খবরের মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য দুটি খবর – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর, স্বামী হাসান সাইদ কর্তৃক নির্যাতিত এবং শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষিত। ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। নির্যাতক দু’জনই পুরুষ এবং উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু তাদের পারিবারক শিক্ষা ও স্বশিক্ষার স্থান শুন্যের ঘরে। যথাযথ পারিবারিক শিক্ষা থাকলে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকেনা। পরিবার পৃথিবীর আদি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সন্তানগণ পরিবার থেকেই নীতি নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে উঠে।
সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকারের বেলায় মুসলিম পরিবারিক আইনে তেমন বিভেদ ও বিপর্যয় দেখা যায়। ‘ যদি কোন নারী বিয়ের পর সন্তানের মা হতে না পারেন তবে তাঁর পুরো জীবনই ব্যর্থ হয়ে যায়। পরিবারে তিনি কারো কাছে যোগ্য মর্যাদা ও সম্মান পান না। সংসারে সবাই তাকে হেয় চোখে দেখে, সকাল সন্ধা খেটেও সে কারো মন যোগাতে পারে না। পরিবারে স্বামী, শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী, ননদ, দেবর সবার দেখাশুনা পরিচর্চার দায়িত্ব সেই নি:সন্তান নারীর উপর পড়ে।
তারপর সন্তান জণ্ড না দিয়ে যে দিন তার স্বামী মারা যান বা ছেড়ে যান, সেদিন সেই যতেœর রাণীর গৃহকোনে আর ঠাঁই হয়না। কোন স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণ পোষণের জন্য জমি জমা লিখে দিয়ে যান বা সম্মানজনকভাবে সচ্ছল জীবন যাপনের ব্যবস্থা করে দিয়ে যান তাহলে স্ত্রীর ভরণ পোষন ও সম্মানজনক জীবন যাপনে তেমন কোন অসুবিধা থাকেনা মানসিক কষ্ট ব্যতিত। কিন্তু স্বামী যদি তার স্ত্রীর নামে কোন সম্পত্তি লিখে না দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তাবে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে নি:সন্তান নারী সে তার স্বামীর সম্পত্তির ৪/১ অংশ পায়। আর যে নারীর সন্তান থাকে তবে সে স্বামীর সম্পত্তির ৮/১ অংশ পায়। এই হলো সংসারে মুসলিম সমাজে একজন নারীর প্রকৃত অধিকার।
যদি কোন নারীর বাবা, ভাই খুব ক্ষমতাধর, শক্তিশালী, মর্যাদা সম্পন্ন না হয় তবে স্বামীর মৃত্যুর পর বা ছেড়ে যাওয়ার পর এ সমাজ সংসারে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ে। স্বামীর ঘনিষ্ট নিকট আত্মীয় তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। নিকট আত্মীয় যারা জীবিত থাকে তারাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। যদি একজন স্ত্রীর স্বামীর আপন ভাইবোন বেঁচে থাকে এ সম্পত্তির /১ অংশ বা অর্ধেক পাবে। ৪/১ অংশ স্ত্রী পাবে এবং ৪/১ অংশের মালিক হবে স্বামীর সৎভাই ও বোন যদি থাকে। তাই স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর পাওনা আদায় অত সহজ কোন বিষয় নয়। কোর্ট এর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করতে হবে। এবং তাকে প্রকৃত ওয়ারিশ হিসেবে তার অবস্থান কোর্টে প্রমাণ করতে হবে। তবে সে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে। এযে কত বড় ঝামেলা তা ভূক্তভোগীরা ছাড়া কেউ জানে না এবং এত ঝামেলা মোকাবেলা করার মত যোগ্যতা সমাজে ক’জন স্ত্রীর আছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্ত্রী সম্পূর্ণ নিরুপায়। যে স্ত্রী আত্মীয় স্বজনের জন্য সারাজীবন খেটেছেন কিন্তু স্বামীর মৃত্যু বা ছেড়ে যাওয়ার পর কোন আত্মীয় স্বজনই স্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করেন না। যে স্ত্রী দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে স্বামী তার আত্মীয় পরিজনসহ বসবাস, পরম মমতায় সেবাযত্ম করেছে, প্রেম ভালোবাসা দিয়েছে, স্বামীর মৃত্যু বা ছেড়ে যাওয়ার পর সেই ঘরে স্ত্রীর কোন অবস্থান বা মর্যাদা নেই। এটা সমাজের এবং আইনের কত বড় অন্যায় সেই স্ত্রীর উপর?
নি:সন্তান, তালাকপ্রাপ্ত নারীর আর্থিক কোন বল-ভরসা বা জোর নেই। যদি ঐ নারীর বাবা-ভাই শক্তিশালী বা সম্পদশালী না হন। তবে কোর্টে কেস করে যে তার সম্পত্ত্রি এক চতুর্থাংশ মালিকানা পেতে পারে। নইলে সমাজে যে স্ত্রী জোর বা বল প্রয়োগ করতে পারে এবং সেই মালিকানা পায়।
ইদানিংকালে অবশ্য নারীর অধিকার সম্পর্কিত মানবাধিকার সমন্ধীয় পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এবং নারীর উপর প্রকৃত অত্যাচার হলে কখনো নারী তার প্রকৃত অধিকার পাচ্ছে এমনটি হয়েছে যা সংক্যায় খুবই নগণ্য।
নি: সন্তান স্ত্রীদের স্বামী জীবিতাবস্থায় তাঁর স্ত্রীকে সম্পত্তির কিছুটা অংশ এবং বড় অংকের টাকা পয়সা তার স্ত্রীর নামে দিয়ে দেওয়া উচিত। পরবর্তী জীবনে স্ত্রী সব ধরনের আর্থিক অনিশ্চয়ত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বচ্ছল সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারে। যে স্ত্রী মর্যাদার সাথে সমস্ত জীবনভর স্বামীর সঙ্গে বসবাস করেছে, স্বামীর মৃত্যু বা ছেড়ে যাওয়ার করণে সেই নারী কে সম্পূর্ণ সহায় সম্বলহীন অবস্থায় দাড়াতে হয়। এটি খুবই অমাবিক ও দু:খের বিষয় হয়।
নি:সন্তান স্ত্রী সহায় সম্বলহীন অবস্থায় স্বামীর বাড়ি বা আত্মীয় স্বজনের কাছে থাকার সুযোগ না থাকা স্বাভাবিক। যেহেতু স্বামী তার নামে কোন সম্পত্তি লিখে দিয়ে যাননি। তাঁর (স্ত্রী) কোন সম্পত্তি পাবার আশা না থাকায় সহয় সম্বলহীন অবস্থায় তাকে বাপের বাড়িতে চলে যেতে হয় এবং বাবা ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। কেস করে সম্পত্তি উদ্ধার করাটা সব স্ত্রীর বা নারীর জন্য সহজ কোন বিষয় নয়।
লিখিতভাবে যদি স্ত্রীর কোন সম্পত্তি না থাকে, বা তাঁর নামে ব্যাংকে টাকা পয়সা না থাকে তবে কোনভাবেই কেউ তাকে সহযোগিতা করেনা বরং সবাই করুনার চোখে দেখে। তবে বিবেকবান বিজ্ঞজনদের মতে, জীবিতাবস্থায় স্বামীকে তার নি:সন্তান স্ত্রীর জন্য ভরণ পোষণ, সম্মানজনক মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সম্পদ স্ত্রীর নামে দিয়ে দেয়া উচিত। যাতে স্বামীর মৃত্যু বা ছেড়ে যাওয়ার পর একজন স্ত্রীকে মর্যাদাহীন অবস্থায় বাবা-ভাইয়ের গলগ্রহ হয়ে চিরজীবন দু:খের সঙ্গে জীবন যাপন করতে না হয়। কোন নিঃস্তান স্ত্রী যেন শেষ বয়সে তার স্বামীর অবর্তমানে অর্থনৈতিক অক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় ভরণ-পোশন, রোগে শোকে চিকিৎসার জন্য কষ্ট পেতে না হয়। সে দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে স্বামীর উপর বর্তায়, এবং স্বামীর জীবিতাবস্থায় স্ত্রীর জন্য সে ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী।
Discussion about this post