সাঈদ চৌধুরীঃ একটা সময় আমরা মাদক নিয়ে চিন্তা করতাম । তখন কেবল মানুষের কাছাকাছি ছিল বাংলা মদ ।মানুষগুলো নেশা করে ড্রেনে বা নর্দমায় পড়ে থাকতো । যে মদ খেত সমাজের বেশীর ভাগ মানুষের কাছে সে খারাপ হিসেবে বিবেচিত হত এবং অনেক সময় মাদক সেবীরা আত্নগোপন করেও থাকতো দিনের বেলায়। এই কথাগুলো নব্বইয়ের দশকের কথা ।দিন পাল্টে গেছে ।নেশার ধরন পাল্টেছে । অনেক ধরনের নেশা বস্তু এখন সবার হাতে । নেশা যেমন সস্তা হয়েছে তেমনি পাওয়া যায়ও দ্রুত! ক্যান্সার রোগ আর নেশাখোর যেন অনেক পরিবারেরই অংশ বর্তমানে । অবাক করার মত বিষয় হলেও নেশাখোর মানুষগুলো এখন আর নিজেকে সমাজের চোখে দায়ী ভাবেনা বরং কোন কোন সময় এরাই সমাজের শাসক শ্রেণী বলে বিবেচিত ।যুব সমাজ ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কারণ নেশা তা আগেই প্রমাণিত । এখন ধ্বংসের ফলাফল দেখতে পাচ্ছি আমরা খুব সামনে থেকে । পর পর কাছাকাছি দুদিনে শ্রীপুরের দুটো ঘটনা আরও বেশী ভাববার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । নেশার টাকার জন্য আত্নহত্যা করেছে এক যুবক । ২৩ বছর বয়সের এই যুবক শ্রীপুরের মাওনা চৌড়াস্তায় ভাড়া বসায় থাকতো । প্রায়ই বাবার সাথে ছেলেটির নেশার টাকার ব্যপারে ঝগড়া হত ।ঐদিন বাড়িতে ছেলেটিকে রেখে বাবা বাইরে যায় এবং এসে দেখে গাছে ছেলের ঝুলন্ত লাশ !গত সোমবারের ঘটনা । নেশার টাকার জন্য সন্তানকে বিক্রি করে দেয় এক বাবা । ঘটনাটিও ঘটে শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে । এক মাস আঠারো দিনের শিশুটিকে নেশার টাকার জন্য বাবা বিক্রি করে নিঃসন্তান দম্পত্তির কাছ থেকে আটাস হাজার টাকা নেয় !
যে ঘটনাগুলো প্রকাশ পায় তা আমরা আলোচনায় আনি এবং তা নিয়েই গবেষনা হয় প্রতিনিয়ত । সামাজিক সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান যে পরিবার তাতেই কলহ সৃষ্টি করছে নেশা নামক ভয়ানক একটি মানসিক রোগ ।একেবারে স্কুল পর্যায় থেকে নেশার বিস্তারন শুরু হয়েছে বর্তমানে । কোন কোন সন্তান মা বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ভয় দেখিয়েও নেশার জন্য টাকা নেয় । আমার বাড়ির খুব কাছেই একজনের সন্তানের এমন ব্যবহার আমি দেখেছি । বাধ্য হয়ে বাবা মা তাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়েছে । সে মাদক
নিরাময় কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যেই কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেছে বলেও আমি খবর পেয়েছি । একটি কথা স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে নেশা ধরার পর কোনভাবেই তাকে আর স্বভাবিক জীবনে ফেরানো সম্ভব হচ্ছেনা বেশীর ভাগ সময় । যারা নেশার জন্য নিজের সন্তানকে বিক্রি করার মত সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা কোন কাজটি করতে পারবে না বলে মনে করেন ? গত কয়েক বছরে অপহরন বেড়েছে, আত্নহত্যা বেড়েছে, যৌতুকের নিদারুণ কষাঘাতের চিহ্নও কম নয় এমনকি নেশার টাকার জন্য কেউ কেউ কয়েকটি
বিয়ে পর্যন্ত করে স্ত্রীদের গার্মেন্টেসে চাকুরী করিয়ে নেশার টাকা জোগাড় করে!আইনের ক্ষেত্রেও পুলিশের যথেষ্ঠ তৎপরতা লক্ষ করা গেলেও কিছুদিন আগে শ্রীপুরে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ইয়াবা পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে একজন ছাত্রকে গ্রেফতার করার । এই বিষয়টি যথেষ্ঠ সমালোচনার কারণ দাঁড়ায় ।
একদিকে প্রচুর পরিমানে মাদক ব্যবসায়ী অন্যদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ সত্যিই খুব হতাশার মধ্যে
ফেলে দেয় আমাদের । যারা সত্যিকারের মাদক ব্যবসায়ী তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে গেলেও দেখা
যায় কয়েকদিন পরেই তারা জামিনে বের হয়ে আসছে এবং বের হয়ে এসে আবার মাদক ব্যবসায় জড়িত
হচ্ছে ! মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেটই হল স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী কারণ এরা নিজেরা টাকা উপার্জন না
করতে পারলেও বাবা মা এদের ভরন পোষন করে !
আত্নহত্যা, শিশুপুত্র বিক্রি, স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য চাপ, ধর্ষন সব কিছুর সাথে নেশা নামক ভয়াবহ একটি
ব্যপারের সম্পৃক্ততা রয়েছে । যারা নেশা করছে তারা যদি এত খারাপ কাজ করতে পারে যারা নেশা
আমদানি করছে তারা যে দেশ বিক্রির চেষ্টা করবে না তারই বা বিশ্বাস কি ?
নেশার গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে সমাজকে । স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা রাত দশটার পর অভিভাবক
ছাড়া বাইরে থাকা বন্ধ করে দেওয়া হোক বিশেষ করে গাজীপুরের কিছু কিছু অঞ্চলে । আঠারো বছরের
নীচে মটর সাইকেল চালানোর উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হোক ।স্কুল এবং কলেজগুলোতে চেক করে
ঢোকানোর নিয়ম চালু করা যেতে পারে ।বিশেষ করে গ্রামের দিকে স্কুল টাইমে কেউ বাইরে না যাওয়ার
ব্যবস্থা দ্রুত প্রবর্তন করতে হবে ।স্কুল থেকে বাড়ির দূরুত্ব অনুযায়ী আপনিও আপনার সন্তানকে স্কুলে আনা
নেওয়া করানোর দায়িত্ব নিন ।
প্রশাসনিক ভাবে কিছু জায়গা চিহ্নিত করে সে সে জায়গায় চেকপোস্ট বসালেও ভালো কাজ হতে পারে বলে
মনে করি । মাদক বন্ধ করতে হলে মাদকের বিস্তার বন্ধ করতেই হবে ।তার সাথে যে মাদক নেয় তাকে
বোঝাতে সে সমাজে ঘৃণীত মানুষ ।
একেকটি ঘটনা একেকটি উদাহরন । যদি সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া যায় তবে এই ঘটনাগুলোই অপরাধীরা
দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে পূণরায় অপরাধ সংগঠনে আরও বেশী উগ্র হয়ে উঠতে পারে । পরিবার থেকেও যথেষ্ঠ
সচেতন ভূমিকা আমাদের পালন করতে হবে এখন থেকেই । যদি সন্তাকে কথা না শোনাতে পারেন তবে
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হলেও নেশা বন্ধে করনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করুন । তারুন্য নির্ভর বাংলাদেশ গড়তে হলে নেশাকে না বলা শেখাতেই হবে ।
Discussion about this post