অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারন সম্পাদক। আসন্ন বার কাউন্সিল নির্বাচনে সদস্য পার্থী। আদালতে মামলার জট, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জঙ্গিবাদসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম এর সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি’র সাথে।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: প্রথমে নিজের সম্পর্কে বলুন, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশা, পড়াশুনা…।
শ.ম.রেজাউল করিম: উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পিরোজপুরের নাজিরপুরে অর্থাৎ নিজের এলাকায়। খুলনা বি.এল কলেজ থেকে অনার্স সাবসিডিয়ারি। অনার্স শেষ না হওয়ার কারণে খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রী। পরে দৌলতপুর কৃষি কলেজ থেকে কৃষির ওপর ডিগ্রী। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং এল.এল.বি ডিগ্রী; এই হল পড়াশুনা। পরিবার সম্পর্কে বলতে গেলে, আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার। আমি, আমার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে। আমার স্ত্রীও ল’ ব্যাকগ্রাউন্ডের এছাড়া আমার ছেলে-মেয়ে দুইজনই লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে এক্সটার্নাল কোর্সে আইনে পড়ছে, আশাকরি তারাও আইন পেশায় আসবে। বাবা-মা বেঁচে আছেন, অন্যান্য ভাই-বোনেরাও বেঁচে আছে। সব মিলিয়ে একটা সুখী পরিবার।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: অভিযোগ আছে যে আইনজীবীরা একটি মামলা দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রাখে ফলে মামলা জট বাড়ে, কথাটি কতটুকু সত্য?
শ.ম.রেজাউল করিম: কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু আইনজীবীর দায়িত্বহীনতার জন্য মামলা যে ঝুলে থাকে না একথা বলা যাবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার সনাতনী পদ্ধতি। যত দিন না পর্যন্ত পরিবর্তন সাপেক্ষে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি বিচার ব্যবস্থায় যুক্ত করা না হবে ততদিন বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, বিচার প্রক্রিয়ার অনিশ্চয়তা এবং বিচারহীনতা ইচ্ছা করলেও কাছাকাছি সময়ে দূর করা সম্ভবপর হবে না। একটা রুলের বা সমনের নোটিশে লেখা থাকে চার সপ্তাহের মধ্যে কারণ দর্শাও। কিন্তু উক্ত কপিটি প্রতিপক্ষের কাছে পৌঁছায় কখনো কখনো দুই বছর বা তারও বেশি সময় পর। আর এটা হচ্ছে সিস্টেম এর কারণে, কেননা যে কয়জন কর্মচারি বিচার আদালতে কাজ করে এবং তাদের ওপর যে পরিমাণ কাজের বোঝা কিংবা কাজ করার পদ্ধতি অর্থাৎ সনাতনী টাইপ পদ্ধতি, সনাতনী কম্পিউটার টাইপ, তারপর যে তা বুঝতে পারে না তার জন্য বিচারকের কাছে চলে যাওয়া, বিচারক কারেকশনের নামে কিংবা অন্য কাজের ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে ফাইলটি ফেলে রাখা অথবা অন্যান্য কাজের নথি আদালতে দ্রুত চাওয়ার কারণে যে অর্ডারটা পূর্বে হয়েছে সেটা বাদ দিয়ে কাল সকালে কোন মামলাটার নথি প্রয়োজন সেইটা নিয়ে সেকশনের কর্মচারির ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার জামিন হওয়ার মামলাটার অর্ডারের জন্য নথি দ্রুত পাঠাতে ব্যস্ত থাকতে হয়। ইনজাংশন হওয়ার মামলার দ্বারা যারা বেনিফিটেট তারা ওটার তদবির করে দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করে। ফলে মূল যে মামলাগুলো অর্থাৎ পূর্বের যে মামলাগুলো সেগুলো ঝুলে থাকে। যদি বিষয়টি এমন হতো আদালত যখন যে অর্ডারটা দেবেন তাৎক্ষনিক ভাবে আদালতের এজলাসে বসে অর্ডারটা রেকর্ড হয়ে যাবে, ভুল থাকলে কারেকশনটা ওখানেই হয়ে যাবে। আদালত সেটা দেখে কনফার্ম করবেন এবং ইন্টারনেট কিংবা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিম্ন আদালতে এই অর্ডারটা নিয়ে যোগাযোগ করে এক ঘণ্টার মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের নিকট অর্ডারটা পৌঁছে যাবে। এক কথায় বলতে গেলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সমগ্র বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা দরকার। কেননা এখনো হাতে লিখতে হয় আদালত কি আদেশ দিলেন তারপর ওটা কম্পিউটারে টাইপ করতে হয়। এরপর সেটা বিচারকের কাছে যায়, বিচারক দুইদিন পর আদেশটি কারেকশন করেন, তারপর বিচারকদের সই করার বিষয়টিও সময় সাপেক্ষ। আর এই সনাতনী পদ্ধতির জন্যই যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোন জরুরী আদেশ দেওয়া হয় সেইটাও সাত দিন সময় লেগে যায়। ফলে আদেশের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এই সনাতনী বিচার পদ্ধতি মামলা জট বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া কিছু ছোট ছোট মামলা রয়েছে যেগুলো নির্দিষ্ট সময়সীমার ভেতর শেষ করা যায়। যেমন একটা লিজ নিয়ে একটা মামলা হচ্ছে, লিজের মামলাটা এক বছর মেয়াদী। তাহলে আদেশে উল্লেখ থাকবে, এক বছর যেদিন পূর্ণ হবে উক্ত দিন এই মামলা খারিজ হবে। ফলে ওইদিন মামলাগুলো কার্যতালিকায় এলে কোর্ট একটি কমন অর্ডার দিতে পারত যে এই মামলাগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। অনেক সময় দেখা যায় হাইকোর্টের ওয়ান ফোর মামলার মেয়াদ শেষ, কজ অব একশন শেষ হয়ে গেলেও মামলাটি শেষ হয়নি। ফলে দুষ্ট ব্যক্তিরা হাইকোর্টে মামলা পেন্ডিং আছে বলে সুবিধা ভোগ করে। আর এই সিস্টেমের গ্যারাকলে পরে প্রথম যে মামলা রুজু হয় সেটাও ঝুলে থাকে পাশাপাশি দ্রুত বিচারের নিমিত্তে যে মামলা রুজু হয় তার ও একই অবস্থা হয়। বিচার ব্যবস্থায় ডিভাইডেড সিস্টেমের অভাবে মামলা জট অবিরাম বেড়ে চলেছে। ফলে বিচার ব্যবস্থার উপর বন্ধ্যাত্ব নেমে এসেছে। আবার অনেক সময় আদালতে জটিল কোন মামলা বিচারকের কাছে এলে উক্ত মামলায় সময় বেশি লাগার দোহাই দিয়ে মামলাটি পাশ কাটিয়ে যান। ফলে বিচারকের দায়িত্বহীনতা মামলা জটকে প্রশমিত করে। অপর দিকে কাণ্ডজ্ঞানহীন কিছু আইনজীবী আছেন যারা কোন জটিল মামলা দেখলে সেটা ফেলে রাখে অথবা যে ক্লায়েন্ট অর্থের যোগান বেশি দেন তার মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে উঠে পরে লাগে ফলে আগের মামলাগুলো দৃশ্যপটের বাহিরে চলে যায়। মোটের উপর বিচার ব্যবস্থার সনাতনী পদ্ধতি, বিচারক ও আইনজীবীদের দায়িত্বহীনতা ফলে মামলা জট তথা বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: মামলা জট কমানোর উপায় কি?
শ.ম.রেজাউল করিম: এক কথায় বললে পুরো বিচার ব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর করতে হবে। সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে হবে। ফলে যে মামলা যেদিন রেকর্ড হবে উক্ত দিনই মামলার আদেশটি সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। তাহলে আদেশের সার্টিফাইড কপি দেয়া, রুলের কপি তোলা নোটিশের কপি ইত্যাদি সংশ্লিষ্টের কাছে পৌঁছানোর যে সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া সেটা লোপ পাবে এবং দ্রুত কাজ সম্পন্ন হবে। আর এক্ষেত্রে আইনজীবী ও বিচারক উভয়কেই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক বিচার ব্যবস্থার সাথে প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রযুক্তি নির্ভর বিচার ব্যবস্থা প্রণয়ন করলেই হবে না কেননা প্রযুক্তি জ্ঞানহীন আইনজীবী কিংবা বিচারক নিয়ে মামলা জট নিরসন বা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টি আশা করা হলে তা হবে বাস্তবতা বিবর্জিত।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আইনজীবীদের ভূমিকা কেমন থাকা দরকার?
শ.ম.রেজাউল করিম: বিজ্ঞ আইনজীবীদেরকেও এই তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক বিচার ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসলে আইনজীবী ইচ্ছা করলেও মামলা ঝুলিয়ে রাখতে পারবে না। কেননা সিস্টেমই বলে দেবে যে মামলা নথিভুক্ত হওয়ার সাত দিনের ভেতর আপনাআপনিই কার্যতালিকায় এসে যাবে, তাহলে আইনজীবী মামলা ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন না, অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না এমনকি ঝুলন্ত মামলা দেখিয়ে মক্কেলকে হয়রানি করতে পারবে না। সিস্টেম ঠিক হলে আইনজীবীও ঠিক হতে বাধ্য কারণ উল্লেখিত তারিখে আইনজীবী আদালতে না এলে মামলা খারিজ হয়ে যাবে।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোন চিহ্ন কি আপনার চোখে পড়ে?
শ.ম.রেজাউল করিম: মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। সকল পক্ষ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যেমন দায়িত্বপালন করতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে; পাশাপাশি যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত প্রশ্ন তুলছে বিশেষ করে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো তারাও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে মুখোশ পরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। একটি রাজনৈতিক দল হরতাল ডাকতে পারেন এখানে কে সাড়া দেবেন কি দেবেন না এটা জনগণের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু দেশে দেখা যাচ্ছে কেউ হরতাল না মানলে তার গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, বাসে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মেরে ফেলছে। ফলে মানবাধিকার চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। আবার বিচারকরাও একটা অভিযোগ আসলে তারা মনে করছেন দেশে এতো বড় বড় ঘটনা ঘটছে সেটা এতো লাইটলি দেখা ঠিক হবে কিনা। ফলে তারাও এব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেন। ফলে নিরপরাধ কেউ গ্রেপ্তার হয়ে আসলেও সঠিক বিচার পাচ্ছে না। এখানেও উক্ত নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আর এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রয়োজন দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। আপরাধী যেই হোক না কেন শাস্তি তাকেই পেতেই হবে। তিনি মন্ত্রিপুত্র হোক, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতার সন্তান হোক, তিনি বিচারক কিংবা সমাজের উচ্চ পর্যায়ের ধনী কোন ব্যক্তি হোন তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সকল অপরাধীকে বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে আইন যে সবার জন্য সমান তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের সফলতা ব্যর্থতা আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শ.ম.রেজাউল করিম: আইনের শাসন এখনো পরিপূর্ণভাবে আমরা পাইনি। আইনের শাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে যা কিছুই হবে তা আইন সঙ্গতভাবে হতে হবে। কিন্তু আইনের বাহিরে কিছু করা যাবে না। আইন যদি যুগোপযোগী না হয় সেক্ষত্রে আইন সংশোধন করতে হবে। সংবিধান অনুসরণ করে সকল কিছু পরিচালনা করতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি হলো নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত কোন ভাবেই পক্ষপাতিত্ব থাকবে না অনুকম্পা থাকবে না কঠোরভাবে তথা আইনানুগভাবে বিচারকদের কাছে আসা অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। বিচারক যদি এব্যাপারে কারো নিকট আজ্ঞাবহ হন কিংবা কেউকে অনুকম্পা দেখান অথবা বিদ্বেষ পূর্ণ আচরণ করেন তাহলে সেটা হবে জঘন্যতম অপরাধ। আর এই জন্য বিচারকদেরকেও তাদের কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ করতে হবে। কেননা আইনদের দৃষ্টিতে সবাই সমান, বিচারকও আইনের উর্ধে নন।
আইনের শাসনের ব্যর্থতা বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমত, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একেবারে চট করেই কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে যারা ছিল একসঙ্গে ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীদেরকে জেলখানা থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে যারা সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তাদের বিচার না করার জন্য ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করা হয়েছে। জেলখানায় চার নেতা হত্যা মামলার বিচার করা যাবে না এমন একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছিল। এরপর রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার কথা অর্থাৎ উপরাষ্ট্রপতি কিংবা স্পীকার তাদেরকে ক্ষমতা না দিয়ে যিনি সরকারি চাকরি করতেন তিনি হুট করেই সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে গেলেন। আরো খারাপ বিষয় হলো যাকে সংবিধান সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করে মার্শাল ল’ জারি করে দিলেন। এভাবেই দায়মুক্তির সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় অপারেশান ক্লিনহার্ট দেখেছি আমরা। যেখানে দায়মুক্তির অধ্যাদেশ-২০০৬ জারি করা হল। শুরুহল বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। অর্থাৎ উক্ত অপারেশনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যারা মারা গিয়েছে তার কোন বিচার হবে না। সফলতার ব্যাপারে বলতে গেলে ১৯৯৬ এ ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স বাতিল হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার হল। জেল হত্যা মামলার বিচার হল। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আর এভাবেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। এখন হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা মামলার আসামি হয়েছে, সাবেক সেনা প্রধান হওয়া সত্ত্বেও ডেসটিনির চেয়ারম্যান দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও এমপি বদি জেল খেটেছে। আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এখনো দুদকের বারান্দায় দৌড়ঝাঁপ করছে। আর এভাবেই দলের ভেতর কিংবা বাহিরের যে যেখানেই থাকুক না কেন অপরাধ করলে শাস্তি প্রদান করতে পারলে এবং এই চর্চা আরও কঠোরভাবে করতে পারলে আইনের শাসন আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান মানবাধিকারের জন্য কতটা হুমকি তৈরি করেছে?
শ.ম.রেজাউল করিম: আসলে ইসলামী জঙ্গিবাদ না, ইসলাম কখনো জঙ্গি কর্মকান্ডকে সমর্থন করে না। ইসলাম মানুষ হত্যা বোমাবাজি কখনোই সমর্থন করে না। যারা এসব করে তারা নিজেদের দাবি করে মৌলবাদী। কিন্তু মৌল নীতি বিবর্জিত কাজ তারা করে ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে। কোন ধর্মই কিন্তু মানুষ হত্যার পক্ষে নয়। যেমন মানুষ মেরে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখত বাংলা ভাই। সারাদেশে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলার ঘটনা ইসলাম কেন কোন ধর্মই সমর্থন করে না। এরা ধর্মের নাম বিক্রি করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। যেমন আইএস মানুষ পুড়িয়ে মেরে দাবি করে ইসলামিক ষ্টেট এরা ইসলামের শত্রু এরা অপরাধী ষ্টেট এরা মানবতা ধ্বংসকারী ষ্টেট। আর এই ধর্মের নাম ব্যবহারকারী সন্ত্রাসীদের বিচার দুই অপরাধে হওয়া উচিৎ এক এরা ধর্মের নামে ব্যবহার করে শান্তির ধর্ম ইসলামকে কুলষিত করছে পাশাপাশি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে বেড়াচ্ছে। এই অপরাধীদের অপরাধ অন্য অপরাধ থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে গুরুত্বের সাথে এদের বিচার না করলে মানুষ শান্তির ধর্ম ইসলামের ওপর আস্থা হারাবে।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেনা বলে অনেকে অভিযোগ করেন, আপনি কি মনে করেন?
শ.ম.রেজাউল করিম: বিচার বিভাগ এখন পরিপূর্ণ ভাবে স্বাধীন। এখন যদি কোন বিচারক স্বপ্রণোদিত হয়ে কারো আজ্ঞাবহ হয়ে থাকেন অথবা তিনি যদি মনে করেন বিএনপি’র কর্মীকে জামিন দেবেন না এটা পুরোপুরি তার মন জাগতিক ব্যাপার, এটা তার দায়িত্বহীনতার পরিচয়। আইনের অনুশাসন মেনে যদি কোন বিচারক বিচার করেন তার সামনে আওয়ামীলীগের লোক আসুক কিংবা বিএনপি’র লোক আসুক সেটা দেখা উচিৎ নয়। কেননা বিদ্যমান আইনে একজন বিচারককে প্রশাসনিকভাবে কিছু করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু পরাধীন বিচার বিভাগের আমলের কিছু অভ্যাস হয়ত কোন কোন বিচারকের এখনো রয়ে গেছে। তারা কেউ কেউ সেচ্ছায় আজ্ঞাবহ হয়ে সকারের পক্ষে কিংবা সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেন। যা বিদ্যমান আইনের অসম্পূর্ণতা নয় বরং উক্ত বিচারকের অযোগ্যতা, দুর্বলতা তথা রাজনৈতিক আজ্ঞাবহতা।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের আইন সহায়তা কার্যক্রম সত্যিকার অর্থে জনগণ কতটুকু সুফল ভোগ করছে বলে আপনি মনে করেন?
শ.ম.রেজাউল করিম: দেশে আইন সহায়তা কার্যক্রমের ফান্ড আছে ও ইনফাস্ট্রাকচার আছে এবং ইউনিয়ন থানা পর্যায়ে এর কমিটি রয়েছে। এক্ষেত্রে যাদের আইন সহায়তা প্রয়োজন তারা উক্ত কমিটিতে দরখাস্তের মাধ্যমে আবেদন করবে এবং দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেই আবেদন যথাযথ জায়গায় পাঠাবেন তারপর সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটার প্রচারণা খুবই কম। ফলে অনেকেই সরকারি এই সুযোগের কথা জানেন না। এমনকি অনেক আইনজীবীও জানেন না এই মামলায় লড়ার জন্য তিনি ভাল পারিশ্রমিক পাবেন। যার ফলে দেখা যায় আইন সহায়তার জন্য সরকারি যে ফান্ড বরাদ্দ থাকে তার দুই-তৃতীয়াংশ বছর শেষে ফেরত চলে আসে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এই সুযোগ না পাওয়ার দায়ভার সরকারের নয়। এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী স্থানীয় প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের। যেভাবে এই সুযোগটির বিষয়ে মানুষকে জানানো দরকার সেটা করতে তারা ব্যর্থ।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: নিম্নবিত্ত মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন বলে একটি অভিযোগ আছে। এর সত্যতা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
শ.ম.রেজাউল করিম: এটা সত্যি যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। কারণ অপরাধীরা কোন না কোনভাবে প্রভাবশালী থাকে। শক্তির প্রভাব, ক্ষমাতার প্রভাব, অর্থের প্রভাব আর এই তিন প্রভাবের কাছে পরাজিত নিম্নবিত্তরা। থানায় গেলে এই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে থানা মামলা নেয় না কোন কোন ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার পরও আদালতে সাক্ষী দিতে কেউ রাজি হয়না আবার সাক্ষী দিলেও বাড়ি ফেরার পথে সাক্ষীর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে সমাজ ব্যবস্থায় আর্থিক যে বিশাল বৈষম্য রয়েছে তা যতদিন দূর হবে না ততদিন নিম্নবিত্ত মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে। অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থা সবার জন্য সমান সেটা প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি পুঁথিগতই থেকে যাবে বাস্তব প্রয়োগ সম্ভবপর হবে না। আর এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ হল দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। আর আইনের উর্ধে নন কেউ সেই বিষয়টি সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কেননা একজন ধনীর বিচার হলে একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে ফলে অপর ধনী ব্যক্তি অপরাধ করার আগে চিন্তা করবে যে ধনী হলেই কাজ হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর ফাঁসি হাওয়ায় কালা অমুক সাদা অমুক অপর শীর্ষ সন্ত্রাসীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে আমরা দেখেছি। আইনের চোখে সব অপরাধীই সমান।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: তরুণ আইনজীবীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
শ.ম.রেজাউল করিম: তরুণ আইনজীবীদের অনুভব করতে হবে আইন পেশা বৃহৎ সমুদ্রের মত। শুরুতেই উপার্জনের চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে আইন শিখতে হবে। অর্থাৎ শুরুতে আর্নিং নয় শুরুতে লার্নিং। আইন পেশার প্রাথমিক বিষয়গুলো একজন তরুণ আইনজীবী শিখতে পারলে তার ফাউন্ডেশনটা মজবুত হয়। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছুদিন জুনিয়রশিপ করেই নিজে চেম্বার নিয়ে বসে যান। ফলে আইন বিষয়ে অল্প শিক্ষার কারণে তার ফাউন্ডেশনটা মজবুত হয় না। আইন পেশায় ভালো করতে হলে শেখার অদম্য মানসিকতা থাকতে হবে, অন্য পেশার মতো পার্ট টাইম পেশা মনে না করে গভীর মনোনিবেশ করতে হবে। আদালতে গিয়ে কার্যক্রম চলাকালীন মনোযোগ দিয়ে বিচারক কি বলেন সিনিয়র আইনজীবীরা কি বলেন তা প্রতিনিয়ত শুনতে হবে, এখান থেকে শিখতে হবে। তবেই আইন সম্পর্কিত জ্ঞানের ভিত্তিটা মজবুত হবে। অন্যথায় স্বল্প জ্ঞান নিয়ে আইনজীবী হয়ে অর্থ উপার্জন করে বাড়ি গাড়ীর মালিক হওয়া গেলেও আইন পেশার যে মহতী উদ্দেশ্য তা হাসিল করা যাবে না।
ল’ইয়ার্সক্লাববাংলাদেশ.কম: ধন্যবাদ আপনাকে।
শ.ম.রেজাউল করিম: ধন্যবাদ।
Discussion about this post