‘স্যার! পুলিশকে বহুবার বলেছিলাম আমি নির্দোষ, খুন করি নাই। ওই ঘটনার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে নাই। পুলিশ শুধু সন্দেহ করায় জীবনের ১৭টি বছর চৌদ্দ শিকের লাল দালানে থাকতে হয়েছে। এক বছর আগে আমার মা মারা গেছেন, দেখতে পারি নাই। জেলে যাওয়ার কিছুদিন পর স্ত্রীও ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আমি মুক্তি পেয়ে কী করব? ঠিকানাও ভুলে গেছি। বাড়ি যাওয়ার রাস্তাও মনে নেই। আমাকে খালাস দিলে কী হবে?’ আদালতের রায় শুনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এভাবে বিচারকের কাছে অভিযোগ এবং নিজের হতাশা প্রকাশ করেন খালাস পাওয়া আসামি বাবুল।
সম্প্রতি আইনি যুক্তিতর্ক শেষে ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান আসামি বাবুলকে নির্দোষ প্রমাণ করে খালাস দেন। তবে ১৭ বছর কারাভোগের পর খালাস পেয়েও খুশি হতে পারেননি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মধ্যপাড়া করারবাগ এলাকার বাবুল। হাজারো প্রশ্ন নিজের জীবন ঘিরে। কোথায় যাবেন? কী করবেন? কে দেবে আশ্রয়? ১৯৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর মীরহাজিরবাগে খুন হন মোখলেসুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। এ ঘটনায় নিহতের বাবা আবদুস ছাত্তার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ডেমরা থানার মামলা নম্বর-১৫৩(১২)৯৮। এ মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি বাবুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনার তদন্ত করে একই বছরের ১১ এপ্রিল বাবুলসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন এসআই আবদুল হামিদ। মোখলেস হত্যা মামলায় নয়জনকে পুলিশ সন্দেহ করে গ্রেফতার দেখিয়েছিল। অন্য তিন আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে গেলে দীর্ঘ সময় ঝুলতে থাকে। কপাল পোড়ে বাবুলের। জামিন না পাওয়ায় তার নির্দোষ জীবনের সোনালি সময় কারাগারে কাটে বছরের পর বছর।
গত জুনে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শনে গেলে ভাগ্যক্রমে আলোর দেখা পান বাবুল। তুলে ধরেন দীর্ঘদিন তার মামলার নথি আদালতে উপস্থাপন না করার অভিযোগ। পরে প্রধান বিচারপতির দফতর থেকে বাবুলের মামলার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়। এরপর বদলে যায় সবকিছু। মামলার নথি বদলি হয়ে যায় ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামানের কাছে। বিশেষ দায়রা মামলা নম্বর-৫৫৪/১৬। এরপর ধার্য তারিখে বাবুলকে কারাগার থেকে হাজির করা হয় আদালতে। বিনা বিচারে আসামি বাবুল কীভাবে এ মামলায় এতদিন কারগারে রয়েছেন, তা শুনে বিস্মিত হন বিচারক। এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাবুল হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর আইনগত প্রক্রিয়া শেষে আদালতের রায়ে বাবুল নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় মুক্তি পান।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশ এ রকম মামলা দিয়ে মানুষকে বিপদে ফেলে। গরিব মানুষ তদবির করতে পারে না। আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, জেলখানা যাদের নিয়মিত পরিদর্শন করার কথা তাদের প্রত্যেকেরই অবহেলা রয়েছে। নইলে ১৭ বছর একজন বিনা অপরাধে আটকে থাকতে পারেন না। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
Discussion about this post