অপহরণের নাটক সাজিয়ে বাবার কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার মুক্তিপণ আদায় করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন একজন টেক্সটাইল প্রকৌশলী। তাঁর নাম মেহেদী হাসান। তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পাশাপাশি বগুড়ার পারফেক্ট কোচিং সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করছিলেন।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বগুড়ার গাবতলী উপজেলা থেকে তাঁকে আটক করা হয়।
অপহরণ নাটকে সহযোগিতার দায়ে আটক করা হয় মেহেদীর স্ত্রী এবং বগুড়ার বেসরকারি রিলায়েবল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে। তিনজনকেই পরে মেহেদীর বাবার দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
অপহরণ নাটকের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তা গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরতে আজ শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় বগুড়ার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে গ্রেপ্তার তিনজনকে গণমাধ্যমের মুখোমুখি করা হয়।
মেহেদী হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি ২০১৪ সালে নোয়াখালী সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পাস করেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে তিনি বগুড়ার সাইক গ্রুপের বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনে টেক্সটাইল বিভাগীয় প্রধান পদে যোগদান করেন। এ ছাড়া শহরের কলোনি এলাকায় পারফেক্ট কোচিং সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। সেখানে এ পর্যন্ত তিনি ধার করে প্রায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ভাড়া থাকতেন শহরের নারুলী এলাকায়।
মেহেদী আরও বলেন, সরকারি ভর্তি নীতিমালা পরিবর্তিত হওয়ায় কোচিং ব্যবসায় ধস নামে। কিন্তু এর মধ্যে ধারের টাকার জন্য বাবাসহ অন্য পাওনাদারেরা চাপ দিয়ে আসছিলেন। কোনো উপায় না পেয়ে বাবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়ের কৌশল হিসাবে অপহরণ নাটক সাজাতে তিনি নিজেই আত্মগোপন করেন। এর পর মুক্তিপণের টাকা আদায়ের জন্য এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে ফোন করিয়ে বাবার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চান।
সংবাদ সম্মেলনে বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, চলতি মাসের ৫ তারিখ প্রকৌশলী মেহেদীর বাবা বগুড়া সদর থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, গত ৩ আগস্ট দুপুরের দিকে শহরের কলোনি এলাকার কোচিং সেন্টার থেকে নারুলীর বাসায় ফেরার পথে তাঁর ছেলেকে অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীরা ছেলের মুঠোফোন থেকেই যোগাযোগ করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তিন দিন সময় বেঁধে দিয়ে প্রথম কিস্তিতে বিকাশের মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকা নেওয়ার পর এখন ছেলের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ।
এসপি আরও জানান, মামলার পর মেহেদীকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারে একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়।
বিশেষ দলের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল বলেন, মেহেদীকে উদ্ধারে পুলিশ সদর দপ্তরের সহযোগিতা চাওয়া হয়। এরই মধ্যে ‘অপহরণকারীরা’ মেহেদীর মুঠোফোন থেকে তাঁর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথমে ৩০ লাখ মুক্তিপণ দাবি করে। দর-কষাকষির পর তা ২০ লাখ টাকায় পৌঁছে। মুক্তিপণ দিতে রাজি হওয়ার পর অপহরণকারীরা ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকের চারটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন। কোনো রকম চালাকি বা পুলিশকে জানালে মেহেদীকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেন ‘অপহরণকারীরা’।
এরপর পুলিশ মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করে অপহরণকারীদের অবস্থান এক এক সময় এক এক জায়গায় দেখতে পান।
পুলিশ সুপার বলেন, মেহেদীকে উদ্ধারে যে বিশেষ দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁদের হাতে আসা বেশ কিছু তথ্য দলটিকে গোলক ধাঁধায় ফেলে দেয়। এর মধ্যে ছিল মুক্তিপণ আদায় না হতেই অপহরণকারীদের ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পরিবর্তন, যে চারটি বিকাশ নম্বরে মুক্তিপণের টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে সবগুলোই মেহেদী হাসানের নামে নিবন্ধন করা ছিল, মেহেদীর স্ত্রীর সন্দেহজনক আচরণ এবং মুঠোফোনে স্বামীর সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ এমনকি বাদীর সঙ্গে পুলিশের কথোপকথনের তথ্য অপহরণকারীদের কাছে পৌঁছে যাওয়া। পুলিশ অপহৃত প্রকৌশলীকে উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালেও কাউকে না জানিয়েই বাদী পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দুই লাখ টাকার বিকাশ পাঠান।
পুলিশ সুপার বলেন, ১০ দিন ধরে নানা নাটকীয় ঘটনার পর রহস্য উন্মোচনে মেহেদী স্ত্রীকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে এনে জেরা করা হয়। এ সময় তিনি সাজানো এ নাটকের কথা জানান। পরে তাঁকে দিয়েই মেহেদীকে ধরার ফাঁদ পাতা হয়। স্ত্রীকে দিয়ে পিরোজপুর থেকে ডেকে এনে গতকাল বগুড়ার গাবতলী থেকে আটক করা হয় মেহেদী হাসানকে।-প্রথম আলো
Discussion about this post