আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশে একটা কথা আছে- ‘নেই কাজ তো খই ভাজ।’ দেশের কোনো কোনো মন্ত্রী সম্পর্কে কথাটা খাটে। দেশে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মোটামুটি বিরাজমান। সরকারবিরোধী সমালোচনা আছে, কিন্তু বিরোধী দল মাঠে নেই বললেই চলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট জনপ্রিয়। তার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ সব মহলে প্রশংসিত। তার ভারত সফর নিয়ে বিতর্ক হালে পানি পায়নি। ভাস্কর্য ও কওমি মাদ্রাসা-সংক্রান্ত বিতর্কও খুব উত্তপ্ত নয়। তবুও কোনো কোনো মন্ত্রী নানা বিষয়ে অনাবশ্যক কথা বলে ঝিমিয়ে পড়া বিতর্ককে আবারও জাগিয়ে তোলেন, যা সরকারের অনুকূলে যায় না।
বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্পর্কে আমার ধারণা, তিনি বিজ্ঞ ও বিবেচক মানুষ। তার প্রয়াত পিতা একজন সাহসী ও নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিক ছিলেন। সেই সূত্রে আনিসুল হক সম্পর্র্কেও আমি উচ্চ ধারণা পোষণ করি। কিন্তু আইনমন্ত্রী হওয়ার পর তার কিছু কিছু কথাবার্তা ও কাজকর্ম আমার এই ধারণাকে শক্তিশালী করেনি। সম্প্রতি তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি মাননীয় এস কে সিনহা সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি বেশি বেশি কথা বলেন। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের প্রধান বিচারপতিরাও এত বেশি কথা বলেন না। প্রধান বিচারপতি যেসব কথা বলেন, তা আমাদের কাছে বললেই পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি।’
মন্ত্রীর মন্তব্যটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, তিনিই বেশি বেশি কথা বলছেন। তিনি দেশের প্রধান বিচারপতিকে জ্ঞানদান করতে চাইছেন। তার এখতিয়ারের বাইরে কথা বলছেন। তিনিও প্রধান বিচারপতিকে যেসব কথা বলেছেন, তা ব্যক্তিগতভাবে তাকে জানাতে পারতেন। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে রাষ্ট্রের দুই অঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক উস্কে দিতে নাও পারতেন। ভারতের প্রধান বিচারপতিদের কথাবার্তা সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তাও সঠিক নয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারের কোনো গঠনমূলক সমালোচনা নেই বললেই চলে। যা আছে তা হলো সরকারের ভালোমন্দ সব কাজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বিরোধিতা (যেমন দিলি্ল বৈঠক সম্পর্কে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেওয়া) অথবা সরকারের মনোরঞ্জনের জন্য বাড়িয়ে তার সাফল্যের কথা বলা। কিন্তু সঠিক কথাটি বলা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধান বিচারপতি যদি সে দায়িত্বটি পালন করেন, তাহলে কি অন্যায় কাজ করবেন? কোনো গণতান্ত্রিক দেশে পার্লামেন্ট যদি হয় একদলীয়; সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগও যদি নির্বাহী বিভাগের ভুলত্রুটি ধরিয়ে না দেয়, তাহলে সে দেশে গণতন্ত্র চালু থাকতে পারে কি?
আইনমন্ত্রী কি চান_ রাষ্ট্রের প্রথম অঙ্গ নির্বাহী বিভাগের সব কাজকর্ম সম্পর্কে অপর দুই অঙ্গ সব সময় চুপ থাকবে এবং কেবল জি হুজুর বলবে? তাহলে দেশ ভালো চলবে? গণতান্ত্রিক দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এ জন্যই নিশ্চিত করা হয় যে, নির্বাহী বিভাগের ভালো কাজকে তারা সহায়তা দেবেন, ভুলভ্রান্তিগুলোকে ঠেকাবেন। এ কাজটি অতীতের স্বৈরাচারী শাসন আমলে অনেক প্রধান বিচারপতি করতে পারেননি। যারা করেছেন তারা নানাভাবে অপদস্থ হয়েছেন। পাকিস্তান আমলে বিচারপতি মোরশেদ, এরশাদের আমলে বিচারপতি কেএম সোবহান প্রমুখের কথা বলা যায়।
বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে বিচার বিভাগের যে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সত্তা রয়েছে- প্রধান বিচারপতি সিনহা তার কথাবার্তা ও কাজেকর্মে সেটাই প্রমাণ করতে চাইছেন। তিনি সরকারের সমালোচনা করেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সত্য গোপন করে ভুল তথ্য উপস্থাপনের কথা বলেছেন এবং এই ভুল তথ্যের ওপরে বিচার বিভাগ-সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো বিষয়ে সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন। এগুলো তার ব্যক্তিগত অভিযোগ নয়; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও অধিকার সম্পর্কিত অভিযোগ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বার্থেই এই অভিযোগগুলোর প্রতিকার হওয়া দরকার।
আইনমন্ত্রী তা বোঝেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা বুঝেছেন। তিনি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য আবাসিক ভবন উদ্বোধনের সময় রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ_ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকার ওপর জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘এই তিন অঙ্গ একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে।’ আইনমন্ত্রী সম্ভবত এটা বোঝেন না। তিনি হয়তো ভাবেন, বিচার বিভাগ বুঝি আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাধীন। তাই তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতির উচিত ছিল প্রকাশ্যে কিছু না বলে মন্ত্রীকে তার বক্তব্য জানানো।
এখানেও আইনমন্ত্রী ভুল করেছেন। প্রধান বিচারপতির জবাবদিহি আইন বিভাগ বা আইনমন্ত্রীর কাছে নয়। তার জবাবদিহি রাষ্ট্রপতির কাছে। তদুপরি, আইন বিভাগ শুধু আইন তৈরি করে, তার ব্যাখ্যাদানের দায়িত্ব ও অধিকার বিচার বিভাগের। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতিকে তার বক্তব্য মন্ত্রী বা নির্বাহী বিভাগকে বলার কথা বলে আইনমন্ত্রী তার এখতিয়ার-বহির্ভূর্ত কথা বলেছেন। আমি তার কথার ওপর নয়; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছি। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে কাজ করবে।’ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কথাবার্তাতেও বোঝা যায়, তিনি এই সম্পূরক শক্তি হিসেবেই বিচার বিভাগের ভূমিকা রাখতে চান, নির্বাহী বিভাগের বিরোধী পক্ষ হিসেবে নয়।
এই ব্যাপারে বাংলাদেশে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়ে থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমেই মিটানো যেতে পারে; বিতর্ক সৃষ্টি বা প্রধান বিচারপতিকে জ্ঞানদানের মাধ্যমে নয়। প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা গণতন্ত্রসম্মত এবং রাষ্ট্রের দুই স্তম্ভের মধ্যে সমন্বয় বিধান রাষ্ট্রের স্বার্থেই প্রয়োজন। আইনমন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে বেশি কথা না বলার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি ইতিহাস খুঁজলে দেখবেন, দেশে এবং বিদেশে যেসব বিচারপতি নিজের স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে বেশি কথা বলেছেন, তারাই ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানে জাস্টিস কায়ানি, ভারতের বিচারপতি ভার্গব, বাংলাদেশের জাস্টিস মোরশেদ এবং আরও অনেকের নাম উল্লেখ করা যায়। ভবিষ্যতে তাদের নামের সঙ্গে হয়তো বিচারপতি সিনহার নামও উচ্চারিত হবে। পাকিস্তানের কায়ানি আইয়ুব আমলের প্রথমদিকের আইনমন্ত্রী মোহাম্মদ ইবরাহিমের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এমনকি আইয়ুবের বেসিক ডেমোক্রেসি নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেছিলেন। সবাই তাকে প্রশংসা করেছেন। কেউ বলেননি, তিনি বেশি কথা বলছেন। বাংলাদেশের বর্তমান আইনমন্ত্রী মনে করছেন, বিচারপতি সিনহা দেশের বিচার বিভাগের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে কথা বলে বেশি কথা বলছেন। আমার মনে হয়, বিচার বিভাগের যে অধিকারগুলো বর্তমানেও খর্ব হচ্ছে বলে বিচারপতি সিনহা অভিযোগ তুলেছেন, সেগুলো সম্পর্কে আইন বিভাগ প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথভাবে অবহিত করলে তিনি তার প্রতিকারের ওপর বেশি জোর দিতেন।
আইনমন্ত্রী ভারতের তুলনা টেনেছেন এবং বলেছেন, সে দেশের প্রধান বিচারপতিরা বেশি কথা বলেন না। তিনি কি ভারতের বিচার বিভাগের সাহস ও স্বাধীনতার ইতিহাস জানেন? ভারতের একজন বিচারপতিই কি সিটিং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অনিয়ম করার দায়ে তার নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করেননি? আরেক বিচারপতি তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর তিহার জেলে বন্দিজীবন যাপন করতে পাঠাননি? আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট পদে সদ্য অধিষ্ঠিত মহাপরাক্রমশালী ডোনাল্ড ট্রাম্প ৬টি মুসলিম দেশ থেকে মুসলিম নাগরিকদের আমেরিকায় আসা বন্ধ করে দিয়ে যে নির্বাহী আদেশ দিয়েছিলেন, তা কি একজন বিচারক ঠেকিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাননি?
বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার আমল পর্যন্ত বিচার বিভাগ মাথা তুলতে পারেনি, বরং জিয়াউর রহমান ও এরশাদ এক শ্রেণির প্রধান বিচারপতিকে তাদের স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসনের ছাতা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যারা ছাতা হতে চাননি, তাদের কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন এবং কাউকে অন্যভাবে অপদস্থ করেছেন। পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের গতবারের শাসনামলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিবাদ চূড়ান্তে পেঁৗছেছিল এবং নওয়াজ শরিফ গুণ্ডা পাঠিয়ে প্রধান বিচারপতিকে আদালত ভবন থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনাও একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি কখনও বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে যাননি, বরং বিচার বিভাগের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সম্মান দেখিয়েছেন। ভাস্কর্য সম্পর্কেও তার সরকার বলেছে, ‘এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার বিচার বিভাগের।’ এ সম্পর্কে দেশে যখন অনভিপ্রেত বিতর্ক বন্ধ হয়নি, তখন আইনমন্ত্রী কেন প্রধান বিচারপতিকে উপদেশ ও নসিহত দান করতে গেলেন, তা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। নাকি তিনিও পাকিস্তানের আইয়ুব আমলের আইনমন্ত্রীর মতো মনে করেন- প্রধান বিচারপতিও দেশের আইনমন্ত্রীর আজ্ঞাধীন?
আমি বিচারপতি এস কে সিনহার একজন গুণগ্রাহী। প্রধান বিচারপতির পদে বসার পর থেকে তাকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে তার মোকাবেলা করেছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি দণ্ডাজ্ঞা বহাল রেখে এবং কয়েকটি মামলায় সাহসী ও নিরপেক্ষ রায় দান করে তিনি তার পদের ও চরিত্রের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। এখনও তিনি যেসব কাজ করছেন এবং কথা বলছেন, তা বিচার বিভাগের অধিকার ও স্বাতন্ত্র্য সমুন্নত রাখার জন্যই। তা যদি সমুন্নত থাকে, তাহলে তার কৃতিত্ব হাসিনা সরকারের ওপরেও বর্তাবে।
দেশের সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) দেশে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসন ও সংবিধান বদল সম্পর্কে কয়েকটি সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক রায় দিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছেন। এই সাবেক বিচারপতির সঙ্গেও যখন বর্তমান প্রধান বিচারপতির একটা অনভিপ্রেত ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, তখন তার একটা সম্মানজনক মীমাংসা করার উদ্যোগ নিতে পারতেন আইনমন্ত্রী। তিনি তা করেননি। বরং আমি খবর পেয়েছি, তিনি এ ব্যাপারে গোপনে উস্কানিদাতার ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত বিরাগ। খবরটি সঠিক না হয়ে থাকলে তার কাছে আমি ক্ষমা চাই।
বর্তমান প্রধান বিচারপতির অবসর গ্রহণের আর দেরি নেই। অবসরে যাওয়ার আগে বিচার বিভাগের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য তার প্রচেষ্টাগুলোকে প্রধানমন্ত্রী সম্মান ও স্বীকৃতি দেন- এটাই শেখ হাসিনার কাছে আমার বিনীত প্রার্থনা। বিচার বিভাগ শক্তিশালী হলে দেশে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের প্রকৃত ব্যবস্থা হবে এবং আইনের শাসন শক্তিশালী হবে।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ও কলামিস্ট।
Discussion about this post