প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আয়কর রিটার্ন ও স্থাবর সম্পত্তিতে অসঙ্গতির তথ্য মিলেছে। গত বছর নবেম্বরে দাখিল করা আয়কর রিটার্নে ভাইয়ের নামে বরাদ্দ রাজউকের প্লটের ওপর নির্মিত বাড়ি নিজের নামে দেখিয়েছেন তিনি। আবার নিজের নামে বরাদ্দ প্লট আয়কর রিটার্নে দেখাননি। প্রধান বিচারপতির ভাইয়ের প্লটের আকার-আয়তনও বদল হয়েছে। উত্তরায় ওয়াসার পানির পাম্পের ভেতরে দেয়াল তুলে ওই প্লটটি তৈরি করে রাজউক। এ বিষয়ে শনিবার একটি বেসরকারী টেলিভিশন (একাত্তর) বিস্তারিত প্রতিবেদনও প্রচার করে।
জানা গেছে, উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের টার্কিস হোপ ও আগা খান স্কুলের মাঝের জমিটি ২০১৬ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত ছিল ওয়াসার পানির পাম্প। ৩০ জুলাই রাজউক একটি চিঠি দিয়ে ওয়াসার পাম্পের মধ্যে নতুন দেয়াল তুলে ৬ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ১/এ নম্বর হোল্ডিং নম্বর দিয়ে একটি বরাদ্দপত্র জারি করে। সেই বরাদ্দটি দেয়া হয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে। নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে বরাদ্দ এই জমিটি প্রধান বিচারপতি তার নিজের দাবি করে আয়কর রিটার্নে দেখিয়েছেন। সেখানে বাড়িটি ছয় তলা উল্লেখ করা হলেও বাড়িটি নির্মিত হচ্ছে নয় তলা। গত বছর নবেম্বরে দাখিল করা আয়কর রিটার্নে ওই বাড়িটির মূল্য দুই কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী ওই জমি ও বাড়ির মূল্য আরও অনেক বেশি বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নিজস্ব তত্ত্বাবধান ও অর্থায়নেই ওই বাড়িটি নির্মিত হচ্ছে।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা সংরক্ষিত কোটায় ২০১১ সালের আগস্টে তিন কাঠার একটি প্লট পান। তার ঠিক ছয় মাসের মাথায় নতুন আরেকটি চিঠিতে তিন কাঠার প্লটকে পাঁচ কাঠা করা হয়। আরও ছয় মাস পরে ওই প্লটের স্থান বদলে পূর্বাচল থেকে আনা হয় উত্তরার ছয় নম্বর সেক্টরের ওয়াসার পানির পাম্পের জায়গায় দেয়াল তুলে। ভাইয়ের সেই জমিই এখন তার নিজের বলে দেখানো হয়েছে আয়কর রিটার্নে।
রাজউকের বরাদ্দপত্র ঘেটে দেখা গেছে, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে প্রথমে ২০০৩ সালে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে ৩ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় বিশেষ বিবেচনায়। ২০০৪ সালে বিচারপতি সিনহার আবেদনের প্রেক্ষিতে তার নামে বরাদ্দ প্লটটি পাঁচ কাঠা করে ১৫ নম্বর সেক্টর থেকে ১০ নম্বর সেক্টরে নিয়ে আসে রাজউক। ওই জমিতে প্রধান বিচারপতি ছয় তলা বাড়িও নির্মাণ করেন। গত বছর নবেম্বরে দাখিল করা সম্পদের বিবরণীতে এই বাড়িটি উল্লেখ করেননি তিনি। যদিও গত জুলাই মাসে বাড়িটি বিক্রির জন্য একটি বায়নানামা করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেয়া রাজউকের উপ-পরিচালক (এস্টেট) স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ‘নিম্নেস্বাক্ষরকারী আদিষ্ট হইয়া জানাইতেছেন যে, আপনার আবেদন বিবেচনা করিয়া আপনার নামে বরাদ্দকৃত সম্প্রসারিত উত্তরা আবাসিক এলাকার ১৫/এ নং সেক্টরের ০১ নং রাস্তার ৩ কাঠা আয়তনের ১৫ নং প্লটের পরিবর্তে উত্তরা আবাসিক এলাকার ১০ নং সেক্টরের ১২ নং রাস্তার ৫ কাঠা আয়তনের ৫১ নং প্লটটি বরাদ্দ প্রদান করা হইল।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘পূর্বে বরাদ্দকৃত সম্প্রসারিত উত্তরা আবাসিক এলাকার ১৫/এ নং সেক্টরের ০১নং রাস্তার ১৫নং প্লটের কিস্তির টাকা/জামানতের টাকা উত্তরা আবাসিক এলাকার ১০নং সেক্টরের ১২ নম্বর রাস্তার ৫ কাঠা আয়তনের ৫১নং প্লটের কিস্তির টাকা/জামানতের টাকা হিসেবে গণ্য হইবে। অতিরিক্ত দুই কাঠা জমির মূল্য প্রতি কাঠা ৩,০০,০০০/- (তিন লাখ) মাত্র হিসাবে টাকা ৬,০০,০০০/- (ছয় লাখ) মাত্র আগামী ১২.০৬.০৪ইং তারিখের মধ্যে পরিশোধ করিতে হইবে। মূল বরাদ্দপত্রের অন্যান্য শর্তাবলী অপরিবর্তিত থাকিবে।’
প্রধান বিচারপতির আয়কর রিটার্নে বেতনসহ সম্পদের পরিমাণ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। এতে ভাইয়ের নামের প্লটটি ছাড়াও কমলগঞ্জে একতলা একটি বাড়ি উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
আইনজ্ঞরা মনে করেন, সম্পদের সঠিক বিবরণ দাখিল না করলে দুর্নীতি দমন আইনের ২৬ ও ২৭ ধারার আওতায় অপরাধ ছাড়াও আয়কর অধ্যাদেশের আওতায় বিচার্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সাংবিধানিক পোস্টে যদি কেউ যান, তারপর সম্পদটা যদি আগে থেকে ঘোষণা না করেন বা যাওয়ার সময় ঘোষণা না করেন তাহলে তার সাংবিধানিক পদে থাকারও অধিকার নেই।’ সম্পদের হিসাব সঠিকভাবে উপস্থাপন না করা আইন ভঙ্গ করার শামিল বলেও জানান তিনি।
সূত্র: (জনকণ্ঠ এবং একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিবেদন)
Discussion about this post