প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার শপথ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক। তিনি বলেন, সংসদকে অকার্যকর বলা একজন জজের ভাষা হতে পারে না। এটা জুডিশিয়ারির ভাষা হতে পারে না, সুপ্রিম কোর্টের ভাষা হতে পারে না। জজ সাহেবরা একটা ওথ (শপথ) নেন। শপথে বলা হয়, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে আমি কিছু করব না।
তিনি বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলা হয়েছে সংসদ সদস্যরা ইমম্যাচিউরড, সংসদ অকার্যকর, সংসদ আমাদের নির্দেশ মানেনি। এ কথাগুলো যদি অনুরাগ, বিরাগের মধ্যে চলে আসে তাহলে সে জজ সাহেবের পজিশনটা কি হবে, তার শপথ থাকছে কিনা সেটাও আপনাদের বিচার করা উচিত বলে আমি মনে করি। তা অনুরাগ না হোক, বিরাগ তো বহন করছে। সংসদ ও সরকারের প্রতি বিরাগ থেকে যদি প্রধান বিচারপতি এই রায় দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘জাতীয় শোক দিবস, ষোড়শ সংশোধনী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নে রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন বিচারপতি খায়রুল হক। বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড কাউন্সিল টেররিজম নামে একটি সংগঠন এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব ওয়ালিউর রহমানের সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তব্য রাখেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
খায়রুল হক বলেন, ওনার (প্রধান বিচারপতি) বক্তব্যগুলো যদি বিরাগের বশবর্তী হয়ে থাকে তাহলে তার রায়ের কি অবস্থা হবে তা আপনারাই বিবেচনা করবেন। তিনি ওথ বাউন্ড থাকছেন কিনা, সেটাও আপনারা বিচার-বিবেচনা করে দেখুন। আমি পয়েন্ট আউট করে দিলাম। ওথ ভঙ্গ হলে কী হতে পারে তা আপনারাই ভাল জানেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে ইস্যুর বাইরে গিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা আর কিছু না হোক তারা জনগণের প্রতিনিধি। সেটাই তাদের প্রথম যোগ্যতা। এটাই তাদের সব থেকে বড় পরিচয়। তাদের সবাইকে যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হবে এমন তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অবশ্য আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারীও আছেন। ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও সবসময় অত বড় শিক্ষিত পার্লামেন্টারিয়ান পাওয়া যায় না। যদিও এটা অবাক লাগতে পারে। কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট।
বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, রায়ে বলা হয়েছে ১৫২ জন ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আসেনি। তাহলে উনারা (বিচারপতিরা) কি ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন নাকি। এক জায়গায় উনি বলেছেন, সংসদ নির্দেশনা মানেনি। সংসদকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের নেই। সেই নির্দেশ যদি দিয়েও থাকে তাহলে তা মানতে সংসদ বাধ্য নয়। সংসদ হলো সার্বভৌম।
তিনি আরও বলেন, একজন সংসদ সদস্যের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো ক্রাইটেরিয়া হতে পারে না। একজন সংসদ সদস্যের ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে আপনি দেশের মানুষকে ভালবাসেন কিনা বা জনগণ আপনাকে ভালবাসে কিনা। কিন্তু রায়ে সংসদ সদস্যদের ইমম্যাচিউরড বলাটা খুবই দুঃখজনক। কোনটা ম্যাচিউরড আর কোনটা ম্যাচিউরড না সেটা ওনি (প্রধান বিচারপতি) বলার কে? কোনটা কি হবে, না হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক হলেন সংসদ সদস্যরা। জুডিশিয়ারির নয়। এ বিষয়ে একজন বিচারপতি কোনো ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।
১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে খায়রুল হক বলেন, বর্তমানে যে ব্যবস্থা আছে সেটি একটি উত্তম ব্যবস্থা। কারণ এখানে কোনো পক্ষেরই এক্সট্রিম কোনো কিছু করার সুযোগ থাকে না। কারণ এখানে সম্পূর্ণ ক্ষমতাই যদি সকারের ওপর ন্যস্ত থাকে তাহলে হয়তো কিছুটা অপব্যবহার করার সম্ভাবনা থাকে। আবার সমস্ত ক্ষমতা যদি সুপ্রিম কোর্টের ওপর থাকে সেক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে সুপ্রিম কোর্টের সকল বিচারক কিন্তু ফেরেশতা না। তাদেরও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তাদেরও নানা রকম দুর্বলতা থাকতে পারে। কাজেই এক হাতে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা না থাকাই ভাল বলে আমি মনে করি।
খায়রুল হক আরও বলেন, উচ্চ আদালতের একটি রায় কিন্তু আইন। সেটা দেশের জন্য আইন। প্রধান বিচারপতি রায়ের মধ্যে যেসব কথা বলেছেন সেটা যদি বাইরে বলতেন, তাহলে হয়তো এত কথা উঠত না। কিন্তু রায়ের মধ্যে বলেছেন, তখন সেটা আইনের অংশ হয়ে গেছে, এ কারণেই এত আপত্তি। রায়ের মধ্যে সংসদকে অকার্যকর বলা হয়েছে, এটাই সর্বনাশী ব্যাপার। সে কারণে এটা তো আমাদের মনিটরিং করতে হবে, সেটা কারও পছন্দ হোক বা না হোক। ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব।
অ্যামিক্যাস কিউরিদের সমালোচনা করে খায়রুল হক বলেন, ৮-৯ জন অ্যামিকাস কিউরিরা এটাকে সমর্থন করেছেন। জোরেশোরে সাপোর্ট করেছেন। তারা অত্যন্ত বিদ্বান লোক, বোদ্ধা মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা তো সুপ্রিম কোর্টেই প্রাক্টিস করেন। অ্যামিকাসকিউরিদের সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রসঙ্গ টেনে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, যে ব্যক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই ব্যক্তির হত্যা মামলার আপিল শুনানিতে আমরা বিব্রতবোধ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুনতে হাইকোর্টের ৫টি বেঞ্চ বিব্রত হয়েছিল। এর থেকে লজ্জাজনক আর কিছু হতে পারে না। তবে এ মামলায় ১৫ জনের ফাঁসি নিশ্চিত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
Discussion about this post