প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান খোঁজা হচ্ছে সিঙ্গাপুরে। এ লক্ষ্যে সেখানে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। বৈঠকে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ তৃতীয় একটি পক্ষও এসব বৈঠকে উপস্থিত আছে। সম্মানজনক কোনো সমাধান না হলে বিচারপতি এসকে সিনহা শিগগিরই পদত্যাগ করবেন বলে জানা গেছে। প্রধান বিচারপতির একটি ঘনিষ্ঠ ও পারিবারিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্রটি জানায়, কিছু দিন আগে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মাধ্যমে এ দেশ থেকে ই-মেইলযোগে পদত্যাগপত্রের খসড়া নিয়েছেন। এর পর পদত্যাগপত্রটি প্রধান বিচারপতি নিজেই চূড়ান্ত করেন। পত্রটি সঙ্গে করে তিনি একাই সিঙ্গাপুরে এসেছেন। তার স্ত্রী সুষমা সিনহা অসুস্থ থাকায় অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। জানা গেছে, সিঙ্গাপুরে চলমান বৈঠক ফলপ্রসূ না হলে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারেন।
সূত্র আরও জানায়, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা চান সম্মানজনকভাবে দেশে ফিরে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য এজলাসে বসতে এবং তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১১ অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে। কিন্তু আপিল বিভাগের বিচারপতিরা আগেই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে বিচারকাজ পরিচালনায় অপারগতা প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়ায় ওই আকাঙ্ক্ষা পূরণের বিষয়টি অনেকটাই সুদূর পরাহত। আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলও বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমকে বলে আসছেন।
এর আগে গত ১৩ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি একাই দেশত্যাগ করেন। তার ছুটি ১০ নভেম্বর শেষ হচ্ছে। তার দেশে ফেরা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছেন, তিনি দেশে ফিরতে পারেন। আবার কেউ বলছেন, তিনি আর ফিরবেন না। এমনই এক পরিস্থিতিতে গতকাল ওই বৈঠকের খবর আসে।
উল্লেখ্য, গত ১ আগস্ট উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে করা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশ হয়। রায়ে প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগেরও দাবি তোলেন। এরই মধ্যে গত ২ অক্টোবর হঠাৎ করেই এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি। তিনি আবেদনে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে যাওয়ার কথা জানান রাষ্ট্রপতিকে। পরে ৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি অসুস্থ, এটি নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রধান বিচারপতির সুস্থতায় দোয়া করি।
এর পর ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে একটি চিঠি সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, আগামী ১৩ অক্টোবর অথবা এর নিকটবর্তী তারিখে ঢাকা ত্যাগ করবেন প্রধান বিচারপতি। ১০ নভেম্বর অথবা এর নিকটবর্তী তারিখে বিদেশ থেকে ফিরবেন। পরে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে ১১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি ছুটির মেয়াদ ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে জিও (সরকারি আদেশ) জারি করা হয়।
এর পর ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি রাজধানীর হেয়ার রোডে তার বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই। বিচার বিভাগের স্বার্থে আবার ফিরে আসব। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে একটি মহল প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন।’ তিনি একটি লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের দিয়ে যান। পর দিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এর পর ১৭ অক্টোবর রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের ফ্লাইটে প্রধান বিচারপতির স্ত্রী সুষমা সিনহাও অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।
প্রধান বিচারপতির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে বিচারপতি এসকে সিনহার দেশে ফেরা অনেকটাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। কারণ দেশে ফিরলেও আপিল বিভাগের বিচারপতিরা যদি তার সঙ্গে বিচারকাজে বসতে না চান, সেটি হবে প্রধান বিচারপতির জন্য বিব্রতকর। এ অবস্থায় সম্মানজনক সমাধান ছাড়া তিনি দেশে নাও ফিরতে পারেন। এ লক্ষ্যেই সিঙ্গাপুরে একটি সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা চলছে। বৈঠকে সম্মানজনক সমাধানের পথ বের না হলে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন।
এদিকে সম্প্রতি কানাডার অন্টারিওভিত্তিক একটি বাংলা অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন। ছুটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার পদত্যাগ কার্যকর করার অনুরোধ জানাবেন তিনি। তার পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে ওই প্রতিবেদনটি করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে প্রধান বিচারপতির ছুটি শেষ হলে তিনি কী করবেন, এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রধান বিচারপতির দেশে ফেরা ও এজলাসে বসে বিচারকাজ পরিচালনার বিষয়টি সুদূর পরাহত। তবে উনি কী করবেন তা তো আমি জানি না। ছুটি বাড়াবেন কিনা বা দেশে ফিরবেন কিনা, এ বিষয়ে তো আমি জানি না। তবে প্রধান বিচারপতি হিসেবে উনার দায়িত্ব পালন সুদূর পরাহত। তিনি ফিরলেও আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা তার সঙ্গে বিচারকাজ পরিচালনায় বসতে রাজি না হলে তা হবে প্রধান বিচারপতির জন্য অবমাননাকর।
-আমাদের সময়
Discussion about this post