জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংশোধনের বিষয়টি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা আইন মন্ত্রণালয়ের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আদালতের রায় ও সংশ্লিষ্টদের সুপারিশের ভিত্তিতে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংশোধন হয়। স্বাধীনতার পর গত ৪৫ বছরে সংসদে প্রায় এক হাজার ৪০০ আইন ও অধ্যাদেশ পাস হয়েছে। অথচ সংবিধানে উল্লেখিত উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ, বিচারপতি অপসারণসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইন এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এগুলো ছাড়াও প্রয়োজনীয় অনেক আইন ও বিধিমালা না থাকায় মামলা নিষ্পত্তিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আদালতকে।
সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ ও ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতি অপসারণের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু তা গত ৪৫ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি। একই সঙ্গে সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে উলি্লখিত নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের জন্য পৃথক আচরণ বিধিমালা, শৃঙ্খলা বিধিমালা, জুডিসিয়াল সার্ভিস বিধিমালা, আদালত অবমাননা আইন, শিশু আইনের বিধিমালাসহ অসংখ্য আইন ও বিধিমালার অনুপস্থিতিতে এ-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে আদালত হিমশিম খাচ্ছেন। বিচার বিভাগ-সংশ্লিষ্ট এসব গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইন কমিশনকে ও দেশের আইনজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে সরকারকে লিখিত সুপারিশ করেছেন। বর্তমান সরকারের গত তিন বছরে ৯৮টি আইন পাস হলেও এখনও সংবিধানে উলি্লখিত আইনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আইন ও বিধিমালা সংযোজিত হয়নি।
‘চলতি বছরই বিচারপতি নিয়োগে আইন’: আইন বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিচারক নিয়োগ ও অপসারণে সরকারের একক আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকেই এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে না। অথচ সংবিধানে স্পষ্টভাবে এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, আইন মন্ত্রণালয় বলছে, আইন সংশোধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোনো বিষয়ে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হলে অবশ্যই পৃথক আইন করা বা সে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশার কথা, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে আইন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চলতি বছরের মধ্যেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে আইন করা হবে। খসড়া তৈরির কাজ চলছে।’
অনুমোদনের পরপরই আইন সংশোধন! : আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গত মহাজোট সরকারের আমলে সংসদে পাস হয় ২৬০টি আইন। এর মধ্যে নীতিমালা, কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনার সংখ্যা অর্ধশত। দ্বিপক্ষীয়, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং অনুসমর্থন প্রস্তাবের সংখ্যা ১১৩। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্তমান সরকারের আমলে ৯৮টি আইন পাস হয়েছে।
এর আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংসদে পাস হয়েছিল ১৯৮টি আইন। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৬ বছরে দেশে আইন হয়েছে ৪৭১টি। পাস হওয়ার পর পরই বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট অনেক আইন সংশোধন বা বাতিলের দাবি উঠছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, আইন প্রণয়ন ও ফের সংশোধন কার বা কাদের স্বার্থে করা হচ্ছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আইন প্রণীত হলেও তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। আমলানির্ভর আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আইনে ত্রুটিও থাকছে অনেক। ফলে আইন প্রণীত হতে না হতেই বারবার সংশোধন করতে হচ্ছে। এ ছাড়া আইনজীবী বা জনসাধারণের একটি বড় অংশই জানেন না এসব আইন প্রয়োগের সুবিধাগুলো। অনেকে এ জন্য আইন চর্চার অভাবকেও দায়ী করছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইন সংশোধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সরকার যখন প্রয়োজন মনে করবে, তখনই আইন সংশোধন করা হয়। জনগণের সুবিধার্থেই আইন প্রণয়ন ও সংশোধন হয়।’ তিনি বলেন, আইনমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৪ সালে দাতা সংস্থা এডিবির উদ্যোগে তিনি উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নিয়োগের জন্য একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছিলেন। খসড়াটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলেও তা আর ফেরত আসেনি। নতুন আইন করতে গেলে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে খোঁজ নিতে পারে।
আলোচনার কেন্দ্রে বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণ: উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইন দ্বারা বিচারপতি নিয়োগ লাভের অন্যান্য যোগ্যতা নির্ধারণ করা যাবে। গত ৪৫ বছরেও উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগে কোনো আইন বা বিধিমালা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগের পথ উন্মুক্ত রাখতেই সংবিধান অনুসারে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা বা আইন প্রণয়নের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদিকে, আইন প্রণয়ন ছাড়াও সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বিচারক নিযুক্ত হওয়ার দুটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে ১০ বছরের অথবা বিচার বিভাগের পদে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা। এ প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট ২০১০ সালের ৬ জুন স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের প্রতি রুলও জারি করেন। সংশ্লিষ্ট রিটের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়েছে। বিষয়টি যে কোনো সময় রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।’
এদিকে, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। পরে ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী। গত বছরের ৫ মে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। অবশ্য এরই মধ্যে ওই রায়ের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছে। বর্তমানে আপিলটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ অবস্থায় উচ্চ আদালতের বিচারপতিসহ সাংবিধানিক পদাধিকারী ব্যক্তিদের অপসারণে দেশে এই মুহূর্তে কোনো আইন কার্যকর নেই।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচারপতি নিয়োগে বিতর্ক এড়াতে একটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে। ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল কমিশন অধ্যাদেশ, ২০০৮’ নামের এ অধ্যাদেশে প্রস্তাবিত ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, সততা, সুনামসহ কিছু বিষয় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ অধ্যাদেশের একটি উপবিধিকে অকার্যকর হিসেবে রায় দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করার সুযোগ পেলেও সে পথে এগোয়নি। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট আইন কমিশন থেকেও বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশমালা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারপতি পদে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। এ জন্য বিচারপতি পদে নিয়োগে কমপক্ষে ৫০ বছর বয়স এবং অবসর গ্রহণের বয়স ৭৫ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয়েছিল। এ সুপারিশ করা হয়েছিল নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য। সংবিধানের ৯৬(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, বর্তমানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বয়সসীমা ৬৭ বছর।
প্রতিক্রিয়া: বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংসদে আলাপ-আলোচনা হলে সংশ্লিষ্ট আইনের ত্রুটি অনেকাংশে দূর হয়ে যায়। সংসদে এ ধরনের চর্চা আরও বাড়াতে হবে।’ বিচারাঙ্গন-সংশ্লিষ্ট আইনশূন্যতার বিষয়ে প্রবীণ এ আইনজ্ঞ বলেন, ‘সংবিধানে যেহেতু বলা আছে, এসব আইন প্রণয়ন করতেই হবে। তা যত দিন না হবে, তত দিন বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কথা থাকবেই।’
বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শুধু বিচার বিভাগে নয়, সংবিধানে উলি্লখিত নির্বাচন কমিশন গঠনসহ অসংখ্য আইনের ক্ষেত্রে শূন্যতা রয়েছে। এ জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে, তাদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। বিচারপ্রার্থী ও দেশের জনগণের স্বার্থে এ উদ্যোগ দ্রুত নেওয়া জরুরি।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন ও উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়নের বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।’ সরকার দ্রুত এ আইন প্রণয়ন করে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি।
বিতর্কমুক্ত আইন প্রণয়নের জন্য কার্যকর সংসদ প্রয়োজন উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সবার মতামত নিয়ে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন হলে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব।’
আবু সালেহ রনি/সমকাল
Discussion about this post