মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে হাইকোর্টের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীদের দৈনিক শুনানির জন্য রিটেইনার ফি দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। এই মামলা শেষ হওয়া পর্যন্ত শুনানির জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা পান সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা।
অভিযোগ আছে, পারিশ্রমিক এত কম হওয়ায় মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব দেখা যায়। এর ফলে ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কায় থাকেন বিচারপ্রার্থীরা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী স্বপন কুমার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পারিশ্রমিক কম দেওয়ার কারণে আইনজীবীরা মামলা পরিচালনায় মনোযোগী হন না। এতে করে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। কতিপয় আইনজীবী অসৎ পন্থা অবলম্বন করেন।’
সুপ্রিম কোর্টের সলিসিটর অফিস সূত্রে জানা যায়, নিম্ন আদালতে কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির দণ্ড কার্যকর করতে হলে হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হয়। এটি ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত। হাইকোর্টের নির্ধারিত বেঞ্চে শুনানি শেষে রায় বাস্তবায়ন করা হয়। আর কোনো আসামি ডেথ রেফারেন্স মামলার আপিল করতে অক্ষম হলে বা আপিল না করলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়। এসব আইনজীবীকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলা হয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন সলিসিটর অফিস রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। তাঁদের মামলাপ্রতি ফিও নির্ধারণ করে থাকে সলিসিটর অফিস। এসব গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীদের দৈনিক রিটেইনার ফি নির্ধারণ করা হয় ৩০০ টাকা। শুনানি শেষ করতে এক মাস লাগলেও আইনজীবী ফি হিসেবে পাবেন সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। আর একদিনে শুনানি শেষ হয়ে গেলে আইনজীবী পাবেন মাত্র ৩০০ টাকা। ২০০৬ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়ে আসছে।
এর আগে ফি আরো কম ছিল। মামলার শুনানির জন্য দেওয়া হতো মাত্র ১২০ টাকা করে। সর্বোচ্চ ছিল দুই হাজার টাকা।
আইনজীবীদের ফির বিষয়ে ২০০৬ সালের ১৬ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন সলিসিটর অফিস থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে একটি স্মারক পাঠানো হয়।
তৎকালীন উপসলিসিটর স্বাক্ষরিত ওই স্মারকে বলা হয়, ‘উপরোক্ত বিষয় নির্দেশিত হইয়া জানানো যাইতেছে যে, সরকার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্ত স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ারগণের দৈনিক শুনানি ফিস/সম্মানী ভাতা পূববর্তী সকল সরকারি আদেশসমূহ বাতিলক্রমে ১২০/(একশত বিশ) টাকার স্থলে ৩০০/(তিনশত টাকা) নির্ধারণ করিলেন এবং প্রতি মামলায় সর্বোচ্চ অনধিক ২০০০/(দুই হাজার) টাকা ফি/ সম্মানী ভাতা পাইবেন। এই সিদ্বান্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি রহিয়াছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নথি নং-অম/অবি/প্রবি-৩/সম্মানী-৪/২০০৬ এর নোটানুচ্ছেদে ৫৬-৬০ দ্রষ্টব্য। এই আদেশ ১-১১-২০০৬ ইং তারিখ হইতে কার্যকর হইবে।’
তবে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীদের ফির ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীদের ফি অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের সমান দেওয়া হয়।
সলিসিটর অফিসের হিসাব শাখার দেওয়া তথ্যমতে, বিডিআর বিদ্রোহ হত্যাকাণ্ডের মামলা পরিচালনার জন্য ২০ জনকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছিলেন এ মামলায় রাষ্ট্রনিযুক্ত প্রধান কৌঁসুলি (যিনি অ্যাটর্নি জেনারেল সমমর্যাদায় নিযুক্ত ছিলেন)। আইনমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি এ পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলকে অতিরিক্ত আ্যটর্নি জেনারেল সমমর্যাদা এবং শেখ বাহরুল ইসলাম ও গাজী জিল্লুর রহমানকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মর্যাদায় নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্য ১৬ আইনজীবীকে দেওয়া হয় সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মর্যাদা। এই ২০ জনের মাসিক বেতন এক লাখের কাছাকাছি বা বেশি।
অন্যদিকে, ডেথ রেফারেন্স মামলায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীদের দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন শুনানির জন্য মাত্র তিনশ করে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ আছে আইনজীবীদের মধ্যে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত প্যানেল আইনজীবী শফিকুর রহমান কাজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার হাতে এ মুহূর্তে তিনটি ডেথ রেফারেন্স মামলা রয়েছে। তার মধ্যে রমনা বটমূলে হত্যা মামলায় মুফতি হান্নানের মামলা রয়েছে। একজন আইনজীবী একটি মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে যদি ৩০০ টাকা পারিশ্রামিক পান, তাহলে তিনি মামলার বিষয়ে কতটুকু পরিশ্রম করবেন, সেটা আপনারা বিচার করে দেখেন।’
‘বর্তমান সময়ে একজন দিনমজুর সারা দিন কাজ করলে ৫০০ টাকা আয় করেন। আইনজীবীরা সঠিকভাবে পারিশ্রমিক না পেলে কাজের প্রতি নিরুৎসাহিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।’
সলিসিটর মোজাম্মেল হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবীদের ফি আপিল বিভাগ নির্ধারণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কিছুই নেই। তবে ফি আরো বাড়ানো প্রয়োজন।’
Discussion about this post