বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ বিয়ে হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। আইনে বিশেষ পরিস্থিতির বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালার খসড়ায়ও এই ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ বা বিশেষ বিধানের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। এতে করে এই ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করছেন মানবাধিকার ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা।
গত রোববার মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই বিধিমালা প্রকাশ করা হয়। এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন মহলের আপত্তির মুখে বিশেষ প্রেক্ষাপটে কম বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ের বিধান রেখে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল, ২০১৭ জাতীয় সংসদে পাস হয়। ওই আইনের ১৯ ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং বাবা-মা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। ওই আইনের আলোকে তৈরি বিধিমালার খসড়ায়ও ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বলতে নির্দিষ্ট বয়স উল্লেখ করা হয়নি। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে ও ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেরা বিয়ে করলে তা বাল্যবিবাহ হবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিধিমালার যে খসড়া প্রকাশ করেছে, তার ওপর ৩১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মতামত দেওয়া যাবে। এরপর খসড়া চূড়ান্ত করে তা আইনি মতের (ভেটিং) জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
খসড়া অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থ যাচাই কমিটির কাছে অপ্রাপ্তবয়স্কের পিতা-মাতা বা আইনগত অভিভাবক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক দালিলিক প্রমাণসহ বিয়ের আবেদন করতে পারবে। আবেদন পাওয়ার পর বিভিন্ন বিষয় যাচাই ও অনুসন্ধান করে বিয়ের ‘আবশ্যকতা’ থাকলে সুস্পষ্ট মতামত দিয়ে শিশু আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবে কমিটি। বিয়েটি জোরপূর্বক হচ্ছে কি না; বিয়েটি ধর্ষণ, অপহরণ, জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে হচ্ছে কি না বা এসব কারণে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোনো মামলা বিচারাধীন আছে কি না, তা কমিটি যাচাই করবে। বিয়েটি অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে এবং সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে হচ্ছে কি না, তা-ও যাচাই করবে কমিটি। কমিটির কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচিত হলেই আদালত সংশ্লিষ্ট এলাকার বিবাহ রেজিস্ট্রারকে বিয়ে নিবন্ধনের অনুমতি দেবেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও কমিশনের নারী অধিকারবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান নুরুন নাহার ওসমানী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে এবং সর্বশেষ বিকল্প’ হিসেবে কোন কোন বিষয় বিবেচ্য হবে বা কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান প্রযোজ্য হবে, তা বিধিতে স্পষ্ট করা না হলে এর অপপ্রয়োগ হবে।
গত মে মাসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করে। এতে বলা হয়, আইনের বিশেষ বিধানের প্রয়োগ ১৬ বছর পূর্ণ করা শিশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এই বয়সী এক বা দুজন শিশুর পারস্পরিক সম্মতিতে বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কারণে কোনো শিশু অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলে বা সন্তানের জন্ম দিলে দুই পক্ষ তাদের মা-বাবার সম্মতিতে বিয়ে করার ঘোষণা আদালতে দাখিল করবে। আদালতের কাছে এটি একমাত্র ও সর্বোত্তম সমাধান বলে মনে হলে বিয়ের অনুমতি দেবেন। যদি কোনো এক পক্ষ বিয়ে করতে না চায় এবং বিয়েবহির্ভূত এই সম্পর্কের কারণে মেয়েটি গর্ভধারণ করে, সে ক্ষেত্রে আদালত মেয়েটির ঋতুচক্র নিয়মিত (এমআর) করার জন্য অনুমতি দেবেন।
এর আগে গত মার্চ মাসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিধির যে প্রাথমিক খসড়া করেছিল, তাতেও বলা হয়েছিল যে প্রেমের সম্পর্কের কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজেরা বিয়ে করলে এবং মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হলে বা সন্তানের মা হয়ে গেলে আদালত বিয়ের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারবেন। আবার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটির ভরণপোষণের উপযুক্ত নিকটাত্মীয় কেউ না থাকলে, সে ক্ষেত্রেও আদালত তাঁর বিশেষ এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারবেন।
সে সময় মেয়েশিশুর ভরণপোষণের কেউ না থাকলে তাকে বিয়ে দেওয়াসহ সরকারের পক্ষ থেকে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তা গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয় উল্লেখ করে নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা ২০১৭ (খসড়া) চূড়ান্ত করার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু) মাসুক মিয়াকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনকেও রাখা হয়েছিল।
ওই কমিটির সদস্য আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিধিমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে বলে যা শুনছি, সে সম্পর্কে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি ও সচিব নাছিমা বেগম দেশের বাইরে আছেন। সরকারের বিধির খসড়া চূড়ান্তকরণ-সংক্রান্ত কমিটির সদস্যসচিব আবুল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, এই ধারার অপব্যবহার যাতে না হয়, সে জন্য একধরনের বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। গ্রামে অনেক মেয়ে ভালোবাসার সম্পর্কের কারণে বিয়ের আগে গর্ভবতী হয়। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাত করানো যায় না। এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হবে। তাঁর মতে, বিশেষ বিধানে বয়স সুনির্দিষ্ট করা হলে তখন রব উঠবে সরকার বাল্যবিবাহের বয়স কমিয়ে ফেলেছে। সমাজে ভুল তথ্য যাতে না ছড়ায়, সে জন্য বয়স নিয়ে কিছু বলা হয়নি।
-প্রথম আলো
Discussion about this post