একটি সুস্থ জাতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা, বলেছিলেন প্রখ্যাত মনীষী নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। অথচ আজ এই একুশ শতকে এসেও বাংলাদেশের ৬৬% মেয়ে এখনো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যার প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও বাল্যবিবাহ একটি বড় বাধা। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানতম বাধা হিসেবেও বাল্যবিবাহকে চিহ্নিত করা যায়। বাল্যবিবাহের শিকার ছেলে বা মেয়ে সে যেই হোক না কেন সে তার উচ্চশিক্ষা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুশিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়। ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশু, কিশোরী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিশোররাও উন্নত জীবনব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তিগত তথ্যপ্রবাহ থেকে বঞ্চিত।
জন্মমৃত্যু এবং বিবাহ মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মধ্যে বিবাহিত ব্যক্তির নিজের পছন্দ ও মত প্রকাশের সুযোগ বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ের ক্ষেত্রেই নারীদের নিজের পছন্দ বা মত প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকে না। ধর্মভেদে বিয়ের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা ভিন্ন। হিন্দুধর্মে অবিবাহিতা কন্যা পরিবারের অভিশাপস্বরূপ; যেখানে আবার কন্যার পরিবারকে পণ প্রদানের মাধ্যমে কন্যাশিশুর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়।
পরিবারের বোঝা হ্রাস করার জন্য কন্যা শিশুর বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বাল্যবিবাহের ফলে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ করার ফলে একজন অপ্রাপ্ত বয়সী মায়ের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সংসারের ভার নেয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা না থাকার জন্য সে নানা ধরনের নির্যাতনের মধ্যে জীবন ধারণ করে। এই কন্যাশিশু কখনো কখনো তালাক প্রাপ্তা হয়ে পিতার সংসারে ফিরে আসে এবং তার শিশুসন্তানটিও নতুন করে অসহায় অবস্থায় পড়ে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০-১৯ বছর বয়সের দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয়। সেভ দ্যা চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
বিয়ের মাধ্যমেই পরিবার সৃষ্টি হয়। বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষের দাম্পত্য জীবন শুরু করার আইনগত ভিত্তি হলো বিয়ে। বাল্যবিবাহ নারীর আত্মোন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মনোসামাজিক উন্নয়নসহ নারীর সার্বিক উন্নয়নে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ২০০৯ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ, যা ২০১১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে যাদের ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়েছে তাদের শতকরা বর্তমান হার ৬৬, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ।
বাল্যবিবাহ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনেও সহায়ক হয়। যেমন, শিক্ষার আলো এবং স্বাস্থ্যগত কারণে অল্প বয়সের মেয়েটি তার নিজের সম্পর্কে সচেতন নয়, সুতরাং পরিবার সম্পর্কে তার ধারণা না থাকায় স্বাভাবিক বিষয়। ফলে একদিকে সে স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে বুঝে ওঠার আগেই সংসার এবং পরিবারের ভারে আক্রান্ত হয়।
অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির থেকেও তার ওপর চাপের সৃষ্টি হয়। ফলে শুরু হয় অশান্তি, পারিবারিক কলহ; এবং সর্বোপরি পারিবারিক নির্যাতন। আর এই পারিবারিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয় পরিবারের সবাই। বিশেষ করে শিশুরা ভোগে নানা মানসিক অশান্তিতে। এতে তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়, পরিবারের প্রতি জন্মে নানারকম অনীহা, ফলে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানারকম অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বাল্যবিবাহের শিকার ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের মতো মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, যা তাকে তার সারাজীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিগত কয়েক বছরে শিশু অধিকারবিষয়ক অনেক আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের সব মানবসন্তানই শিশু। বাংলাদেশের শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়।
এসব নির্যাতনের মধ্যে শিশুশ্রম, যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, পাচার, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধরে নেয়া হয়, বিয়ের মাধ্যমেই একটি কন্যাশিশু সব ধরনের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একজন কন্যাশিশু আরো ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়।
বাল্যবিবাহ একদিকে আইন এবং সংবিধানের লঙ্ঘন, অন্যদিকে বাল্যবিবাহের বর ও কনেকে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। যদিও দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী পুরুষের ক্ষেত্রে ২১ বছর পূর্ণ এবং নারীর জন্য ১৮ বছর পূর্ণ হওয়াসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় মেনে চললে তা বৈধ বিবাহ বলে গণ্য হয়।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ অনুযায়ী কোনো এক পক্ষ কর্তৃক উলি্লখিত বয়স পূর্ণ না হলে তা বাল্যবিবাহ বলে গণ্য হয় এবং ওই বিয়ে ব্যবস্থাপনার দায়ে ব্যবস্থাপকদের ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদ- ও ১ হাজার টাকা অর্থদ-ের বিধান রয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।
যাই হোক বাল্যবিবাহের উদ্বেগজনক এ পরিণতি যেহেতু পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর সেহেতু তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সরকার বাল্যবিবাহ বন্ধে নতুন কঠোর আইন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও অদৃশ্য কারণে এখনো তা প্রণীত হয়নি। ফলে বাল্যবিবাহ অহরহ ঘটেই চলেছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অচিরেই নতুন আইনপ্রণয়ন করে তার সঠিক প্রয়োগসহ আপামর জনসাধারণকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতনপূর্বক সম্পৃক্ত করতে হবে। আর দেরি নয়, এখনই সময় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে আসার।
অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত
লেখক : মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী, জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে (ইউএনডিপি) কর্মরত।
Discussion about this post