বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ প্রেক্ষাপটে কম বয়সে বিয়ের সুযোগ রাখার বিধানটি অনুমোদন না করতে এবার রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানাবে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিশেষ করে মেয়েদের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ের বিধান রাখার আইন না করার জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা।
সেই আহ্বান উপেক্ষা করে গত সোমবার ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়। এখন রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের পর এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে।
তাই শেষ চেষ্টায় রাষ্ট্রপতির দ্বারস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে ৭০টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের প্লাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি, গার্লস নট ব্রাইডস বাংলাদেশ, চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ও জাগো ফাউন্ডেশন।
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংগঠনগুলোর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, “আমাদের আপত্তির মধ্যেও সরকার আইনটি পাস করেছে। কিন্তু আমাদের এখনও প্রত্যাশার জায়গা আছে। আমরা রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেব, তিনি যেন এই আইনে স্বাক্ষর না করেন।”
“মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়। কাজেই আইন যেন মানুষের জন্য হুমকি না হয়, সেই বিষয়টি বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি,” সরকারকে আবারও আহ্বান জানান তিনি।
এই আইন পাস হওয়ায় মেয়ে ও ছেলেদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স আগের মতো ১৮ ও ২১ বছর বহাল থাকলেও ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ তার কম বয়সেও বিয়ের সুযোগ তৈরি হল।
তবে বিশেষ প্রেক্ষাপট কী এবং কত কম বয়সে বিয়ে করা যাবে, তা আইনে স্পষ্ট করা হয়নি।
আইন পাসের প্রক্রিয়ার সময় ওঠা প্রশ্নের জবাবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, “বিশেষ বিধানের এই সুযোগ যে কেউ চাইলেই পাবে না।
“কোনো অনভিপ্রেত ঘটনার ক্ষেত্রে পিতামাতা বা বৈধ অভিভাবক এবং আদালতের সম্মতি লাগবে। আদালতের অনুমতি ছাড়া কেউ বিয়ে দিতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়। কাজেই আইন যেন মানুষের জন্য হুমকি না হয় সেই বিষয়টি বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি।
কম বয়সে বিয়ের সুযোগ রাখার বিরোধীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সমাজ বাস্তবতার কথা বিবেচনায় রেখেই এই আইন করা হচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী চুমকি বলছেন, “আমরা কন্যাদের সুরক্ষার জন্যই এই ধারা রেখেছি।”
আইনটির নেতিবাচক দিক তুলে ধরে আয়শা খানম বলেন, “যারা নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী নয়, যারা ধর্ষক, তারা এই আইনের সুযোগ নেবে। যার ফলে নারীরা আরও নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হবে।”
নতুন আইনটি আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক বলে দাবি করেন বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো নারী অধিকার সংগঠনটির সভাপতি আয়শা খানম।
বিয়ের বয়স শিথিলের বিশেষ বিধান বাতিল দাবিতে এমন আহ্বান ছিল, কিন্তু তাতে ফল আসেনি বিয়ের বয়স শিথিলের বিশেষ বিধান বাতিল দাবিতে এমন আহ্বান ছিল, কিন্তু তাতে ফল আসেনি
সংবাদ সম্মেলনে মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বর্তমান সরকার আমলে এর আগে আরও কয়েকটি ‘ভালো’ আইন হলেও তার প্রয়োগ না হওয়ার কথা তুলে ধরেন।
“এই সরকারের মাধ্যমে আমরা বেশ কিছু ভালো আইন পেয়েছি। পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ, মানব পাচার বন্ধ, পর্নোগ্রাফি অ্যাক্ট হয়েছে। কিন্তু এই সব আইনের প্রয়োগ হতে দেখিনি আমরা। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ফলে নতুন আরও অপরাধের জন্ম হবে বলে।”
“আইনটি ভালো হতে পারত, কিন্তু একটি ‘তবে’ লাগিয়ে পুরো আইনের উদ্দেশ্যই ব্যাহত করা হয়েছে। আইন তৈরি হয় অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য। কিন্তু সেই আইন যখন নতুন কোনো অপরাধের জন্ম দেবে তা আমরা মেনে নেব না।”
সদ্যপ্রণীত আইনটিকে আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবেলার ঘোষণাও দেন আইনজীবী সালমা।
“এটি আমাদের পারিবারিক আইন, শিশু আইনগুলোর সঙ্গে কনফ্লিক্ট করছে, এজন্য আমরা লিগ্যাল অ্যাকশনে যাব। আজ সকালে আইনজীবীদের সঙ্গে লিগ্যাল অ্যাকশন গ্রুপ এগেইনস্ট চাইল্ড ম্যারেজ প্রতিষ্ঠা করে মিটিং করেছি। ৭-১০ দিনের মধ্যেই আমরা রিসার্চ করে কীভাবে হাই কোর্টে যেতে পারি, তা বের করব।”
জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের নাছিমা আক্তার জলি আইনটি ‘শুভংকরের ফাঁকি’ বলে মন্তব্য করেছেন।
“বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে ১৮ বছরের নিচের বিয়ের কথা, অর্থাৎ বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৮ বছরের নিচের যে কোনো বয়সের মেয়ের বিয়ে প্রদানকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এখানে বয়সের কোনো উল্লেখ নেই, এটা তো ১০-১১ বছরও হতে পারে।”
বিশেষ বিধানের পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি খণ্ডন করে জলি বলেন, “বাচ্চার বৈধতার জন্য ধর্ষকের সঙ্গে যদি বিয়ে দেওয়া হয়, তখন তো সে বাচ্চার বাবা হয়ে যাবে। তখন তো তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।”
গার্লস নট ব্রাইডস বাংলাদেশের হাবিবুর রহমান বলেন, “বিশেষ বিধানের মাধ্যমে কন্যাশিশুদের বিপদের মুখে ফেলা হয়েছে। অপরিণত বয়সে বিয়ের বিধানের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ যেসব জায়গায় আমরা অগ্রগতি পেয়েছি, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি ফোরামের লায়লা খন্দকার আইনটির নানা ধরনের অস্পষ্টতা তুলে ধরে বলেন, “আইনটিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলতে বয়স কত হবে, অভিভাবক পিতা-মাতা ছাড়া আর কে হবে- এসব উল্লেখ নেই।
“আইনে শিশুর মতামতের কথা বলা হয়নি, এই আইনে বিশেষ বিধান কি সেই বিষয়েও কিছু উল্লেখ নেই।”
সংবাদ সম্মেলনে নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক রোকেয়া কবীর, স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভলপমেন্টের পরিচালক রঞ্জন কর্মকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপ পরিচালক রওশন জাহান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বনশ্রী মিত্র, অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের সেলিনা আহমদ, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের রেহানা বেগম, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের তাহমিনা হকও ছিলেন।
Discussion about this post