রাজধানীর আশকোনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অস্থায়ী ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলার ঘটনাটি ‘নব্য জেএমবি’ ঘটিয়েছে বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। সাম্প্রতিককালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নব্য জেএমবির আস্তানা থেকে বোমা ও সুইসাইডাল ভেস্টসহ যেসব আলামত পাওয়া গেছে, একই ধরনের আলামত আশকোনায় থেকেও উদ্ধার করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এছাড়া র্যাবের ধারণা, এই হামলার মাধ্যমে র্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল আত্মঘাতী ওই জঙ্গির।
এখন সিসিটিভি ফুটেজ আর ফোনকল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে হামলাকারী ও তার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন তারা।
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর আশকোনায় হজ ক্যাম্প সংলগ্ন র্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্পে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে হামলাকারী যুবক ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আহত হন র্যাবের দুই কর্মকর্তা।
এ ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা। ঘটনার আলামত সংগ্রহ করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা। নিজেদের মতো করে আলামত সংগ্রহ করে র্যাব।
শুক্রবারের আত্মঘাতী হামলা প্রসঙ্গে র্যাব ও সিটিটিসি কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানান, এটি ছিল পরিকল্পিত হামলা। হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা নব্য জেএমবির কাজ। দুইদিন আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানা থেকে যে ধরনের সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করা হয়েছিলো, এই হামলাকারীর গায়েও ছিল একই ভেস্ট। ভেস্টটি দেখতে ফতুয়া বা হাতা কাটা গেঞ্জির মতো। এতে বিস্ফোরক ভর্তি থাকে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মিরপুরের একটি জঙ্গি আস্তানা ও চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি বানৌজা ঈঁসা খানের ভেতরে বানৌজা পতেঙ্গা মসজিদে বিস্ফোরণের পর আটক আবদুল মান্নানের কাছ থেকেও বোমাসহ একই ধরনের ভেস্ট উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের ধারণা, নব্য জেএমবির ওই সদস্য র্যাবের অস্থায়ী ব্যারাক উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় হামলা চালিয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল দুর্বল করতেই র্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্পে এ হামলা চালানো হয়। তাছাড়া জুমার নামাজের সময়ে ঢাকা শহর প্রায় নিরিবিলি থাকে। তাই হামলার জন্য ওই সময়কে বেছে নেয় হামলাকারী।
যেভাবে চলছে তদন্ত:
আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার পর থেকেই বিমানবন্দর, আশকোনা ও উত্তরাসহ আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত শুরু করেছেন র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হামলাকারী র্যাবের ওই ক্যাম্পে প্রবেশের আগে কারো সঙ্গে দেখা কিংবা ফোনে কথা বলেছিলেন কিনা এসব যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
এছাড়াও শুক্রবার দুপুরের দিকে আশকোনা এলাকার মোবাইল টাওয়ারের অন্তর্ভুক্ত দুই শতাধিক সন্দেহজনক ফোনকল ট্র্যাক করে সেগুলোর কথোপকথন শুনছেন কর্মকর্তারা।
র্যাবের এই অস্থায়ী ক্যাম্পের সাইটে র্যাবের সদর দফতরের নির্মাণকাজ চলছিল। নির্মাণকাজ শুরু হয় তিন মাস আগে। ক্যাম্প সংলগ্ন দাদা স্টোরের স্বত্ত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম জানান, প্রতিদিনই অসংখ্য শ্রমিক মূল গেট দিয়ে ভেতরে আসা-যাওয়া করতেন। অনেক সময় বিনা তল্লাশীতেই তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হতো। ফলে এ ঘটনার সঙ্গে কোনো নির্মাণ শ্রমিকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
এসব বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্ত চলছে। সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে যা দরকার তার সব কিছু করা হচ্ছে। আত্মঘাতী তরুণ কোনো জঙ্গি দলের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
আত্মঘাতী যুবকের মরদেহের পাশ থেকে যেসব জিনিস উদ্ধার:
সুইসাইডাল ভেস্ট থাকায় বোমা বিস্ফোরণের পর নিহত যুবকের মরদেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তবে তার মরদেহের পাশ থেকে বেশ কয়েকটি আলামত পাওয়া গেছে। মরদেহের পাশে একটি কালো ব্যাগ, কালো-হলুদ-সাদা রঙের একটি ক্যাপ, স্যান্ডেল, গামছা, কালো কাপড়ের টুকরা পাওয়া গেছে।
র্যাবের ধারণা, হামলাকারী যুবকের পড়নে কালো প্যান্ট ও সাদা চেক শার্ট ছিল। এছাড়াও মরদেহের পাশে থেকে দু’টি অবিস্ফোরিত বোমা উদ্ধার করা হয়। পরে ওই বোমা দু’টি নিষ্ক্রিয় করে র্যাবের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট।
আইএসের দায় স্বীকার ও র্যাবের অস্বীকার:
এদিকে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার কয়েক ঘণ্টা পর আমাক মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, আত্মঘাতী হামলার তদন্তে এ পর্যন্ত আইএসের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। আইএস দায় স্বীকার করলেও এর কোনো ভিত্তি নেই। বাংলাদেশে আইএস এর কোনো অস্তিত্ব নেই।
ময়নাতদন্ত ও পরিচয় শনাক্ত:
শুক্রবার বিকেলে নিহত হামলাকারীর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এজাজ শফী। এরপর সন্ধ্যায় ময়নাতদন্তের জন্য তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। শনিবার সকালে ময়নাতদন্ত করার কথা রয়েছে।
রেড অ্যালার্ট ও কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা জোরদার:
আত্মঘাতী হামলার পরপরই দেশের ৬৮টি কারাগারে বিশেষ সতর্কতা জারি করে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের ভেতরে কারারক্ষীদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে দায়িত্ব পালন ও অস্ত্রধারী কারারক্ষীদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। কারা অভ্যন্তরে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি আশপাশে টহল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও সব বিমান ও নৌ-বন্দরে অতিরিক্ত সতর্কতা জারি করে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়।
পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, বেতার ভবন, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সচিবালয় এলাকা, কূটনৈতিক এলাকা, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বাস, লঞ্চ টার্মিনাল ও ভিআইপি এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
-জাগো নিউজ
Discussion about this post