মিজানুর রহমান খান
সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চতর বিচারিক প্রশিক্ষণ গ্রহণে প্রেষণে থাকা ১৩ বিচারকের বিদেশ সফরের পর এখন এমন আরও ৩৩ জন বিচারক একই দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী ২২ জুলাই তাঁদের ঢাকা ত্যাগ করার কথা।
অন্যদিকে বিচারিক পদে কর্মরত বিচারকদের মধ্যে এ বিষয়ে কিছুটা হতাশা দেখা দিয়েছে। কারণ, কর্মরত বিচারকদের একজনেরও এ ধরনের সফরে তালিকাভুক্ত হওয়ার কোনো আশু সম্ভাবনা নেই। এটা অবশ্য প্রীতিকর নয়। অস্ট্রেলিয়ায় বিচারক প্রেরণ নিয়ে একেবারে গোড়াতে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধিও অংশ নিয়েছিলেন। সুতরাং শুরুতে যে যোগাযোগ ও সম্প্রীতি ছিল, সেটা পুনরুজ্জীবিত হওয়া দরকার। সারা দেশের বিচারকদের মধ্যে এ নিয়ে অস্বস্তি বিদ্যমান থাকা অস্বাভাবিক নয়।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, সরকার দেড় মাস আগে ৪৭ জন কর্মরত বিচারকের তালিকা করে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য প্রেরণ করেছিল। কিন্তু সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনো উত্তর দেননি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট সূত্র বলেছেন, ওই ৪৭ জনের তালিকা পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেষণে কর্মরত বিচারকদের তালিকার অনুলিপি সরবরাহ করতে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চিঠির কোনো উত্তর সরকার এ পর্যন্ত দেয়নি। দুটি তালিকা সহজেই দুই দিকে যাতায়াত করতে পারে। এটাও সত্য ওই ঘটনার পরে উভয়ের মধ্যে অন্যান্য ইস্যুতে বিদেশ গমন-সংক্রান্ত পত্রবিনিময় কিন্তু থেমে নেই।
উল্লেখ্য, দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো রাজস্ব খাত থেকে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় বিচারকদের সামর্থ্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে সরকার গত মার্চে ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করে। এর আওতায় প্রথম পর্যায়ে দেশের প্রায় ১৭ শ বিচারকের মধ্য থেকে প্রায় ৫ শ জনকে (কারও মতে অনধিক ৩৫০, কারও মতে পর্যায়ক্রমে পুরো সার্ভিস সদস্যরাই যেতে পারবেন) দুই সপ্তাহ থেকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। আইন ও বিচার বিভাগ সূত্র বলেছে, ২৯ মে থেকে এই প্রকল্প কার্যকর করার আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল। সে কারণে সুপ্রিম কোর্ট থেকে কর্মরত বিচারকদের বিষয়ে কোনো উত্তর না পেয়ে তারা (আইন ও বিচার বিভাগ) আপাতত প্রেষণে থাকা বিচারকদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৪ বিচারকের প্রথম তালিকা চূড়ান্ত করা হয়।
জানা যায়, শুধু একজন বাদে বাকি ১৩ জন বিচারক গত ২৭ মে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। যে বিচারক যেতে পারেননি তিনি হলেন আান্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (যুগ্ম জেলা জজ) কেশব রায় চৌধুরী। সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্বশীল সূত্রে জেনেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আনোয়ারুল হক তাঁর অধীনে প্রেষণে কর্মরত ওই ডেপুটি রেজিস্ট্রারের কর্মস্থল ত্যাগ মঞ্জুর করেননি। তাই অন্যদের সঙ্গে তাঁর যাওয়া হয়নি। এই ধরণের একটি পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হোক সেটাই প্রত্যাশিত।
গত ২৫ মে ২০১৭ অস্ট্রেলিয়ায় চার সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত কোর্সে অংশ নিতে আইন কমিশনের জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান এবং আইন ও বিচার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব বুলবুল আহমেদের বিদেশ ভ্রমণ মঞ্জুর করে সরকার। একইদিনে পৃথক আদেশে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী হায়দারের দুই সপ্তাহের কোর্স মঞ্জুর করা হয়। গত ২২ মের আরেক আদেশে বলা হয়েছে, চার সপ্তাহের কোর্সে ১৫ জন বিচারক (২৪ জুলাই থেকে ১৮ আগস্ট) অস্ট্রেলিয়া যাবেন। এর মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগে প্রেষণে আসা একজন ডেপুটি সলিসিটর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। এই ১৮ জন আগামী ২২ জুলাই দেশ ছাড়বেন।
গত ২২ মে সরকার অবশ্য একই দিনে আরও ১৫ জন বিচারককে দুই সপ্তাহের মেয়াদে বিদেশ গমন মঞ্জুর করেছে। তাঁরা ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করবেন। প্রতিটি চিঠিতেই বলা হয়েছে, ১১ এপ্রিল ২০১৬ সালের রাষ্ট্র্রপতির একটি অনুশাসন অনুযায়ী প্রেষণে থাকা বিচারকদের বিদেশ গমনে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের প্রয়োজন নেই। আবার সুপ্রিম কোর্ট যে পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, যে আইনগত এখতিয়ার বলে প্রেষণে থাকা বিচারকদের বিদেশ গমনে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের যুক্তি তাঁরা দিচ্ছেন, সেখানেও রাষ্ট্রপতির অনুশাসনের বরাত আছে।
প্রতীয়মান হচ্ছে, আইনগত ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এতদিন যে অনুশীলন চলে আসছিল তাতে মিশ্র অবস্থা দেখা যায়। যেমন যাঁরা আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে আছেন, তাঁরা বিদেশ যেতে সুপ্রিম কোর্টকে জানাতেন না। আবার দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে থাকা বিচারকেরা আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদেশে গিয়ে থাকেন। সুতরাং সার্বিকভাবে দেখা যায় উভয়পক্ষের অবস্থান যথেষ্ট দূরবর্তী নয়।
সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানালেন, সুপ্রিম কোর্ট উত্তরের অপেক্ষায় আছেন। তার মানে এখন দাঁড়ায় প্রেষণে যাঁরা গেছেন ও যাবেন, তাঁদের তালিকাটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে হাঁটা পথে ১০ মিনিট দূরের সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দিলেই সমাধান। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট এ পর্যন্ত যা লিখেছেন তার অর্থ হলো বিদেশ যেতে তাঁর পরামর্শ লাগবে। আর সরকার বলছে লাগবে না। প্রতীয়মান হয়, এই দুটি শর্তই অত্যাবশ্যকীয় নয়। কারণ, শুধু তালিকা পাঠালেও তা ‘পরামর্শ’ বলে গণ্য হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক জটিলতা দুর করতে একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি যদি শুধুই নামের একটি তালিকা সুপ্রিম কোর্টে পাঠান তাহলে এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের আইনগত ব্যাখ্যা ম্লান হবে না। আবার সুপ্রিম কোর্ট সেটা পেয়ে যদি ওই ৪৭ জনের (আইন মন্ত্রণালয় কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে প্রেষণে থাকাদের মধ্য থেকে দুজনের নাম চেয়েছিল, সেটাও আটকে আছে) বিষয়ে পরামর্শ দিলে তাঁর অবস্থানও বজায় থাকে। আইন ও বিচারমন্ত্রী বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে ভেবে দেখবেন বলে আশা করছি।
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post