সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও প্রমাণে তিন সদস্যের একটি ‘স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব করে বিচারকদের অপসারণ আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতি। এ ছাড়া ওই কমিটিতে সাবেক একজন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন বিশিষ্ট নাগরিককে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র যদিও দাবি করেছে যে, ‘ইন্ডিয়ান জাজেস ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৬৮’ অনুযায়ী নতুন এই আইনটি করা হচ্ছে। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, ১৯৬৮ সালের আইনটিতে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারকদের অন্তর্ভুক্ত রাখার বিধান থাকলেও বাংলাদেশের প্রস্তাবিত কমিটিতে কর্মরত বিচারকদের রাখার প্রস্তাব করা হয়নি। তিন সদস্যের ভারতীয় তদন্ত কমিটিতে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মধ্য থেকে একজন, রাজ্য হাইকোর্টসমূহের মধ্য থেকে একজন এবং স্পিকারের মনোনয়নে বিশিষ্ট আইনবিদদের মধ্য থেকে একজন অন্তর্ভুক্ত হন।
উল্লেখ্য, ওই খসড়ার ওপর আইন কমিশনের মত নিয়ে তা প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। আইনটি নিয়ে অংশীজনের (স্টেক হোল্ডার) মত নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। নতুন এই আইনের নাম ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্য (তদন্ত ও প্রমাণ) আইন, ২০১৬ ’।
তবে আইন মন্ত্রণালয় বিচারকদের আচরণবিধি (কোড অব কনডাক্ট) সম্পর্কে খসড়ায় যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছিল, সেগুলো ব্যাপক কাটছাঁট করেছে আইন কমিশন। মন্ত্রণালয়ের খসড়ায় বিচারকদের সম্পদ বিবরণী দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, যেটি প্রধান বিচারপতি মনে করলে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে পারবেন। এ বিষয়টি বাদ দিয়েছে আইন কমিশন।
এ ছাড়া বিচারকের বাসায় আত্মীয়স্বজনের চেম্বার না থাকার কথাও বলা ছিল মন্ত্রণালয়ের খসড়ায়। এতে আরও বলা ছিল, বিচারকের কোর্টে এমন কোনো আইনজীবীর শুনানি না করা, যিনি তাঁর আত্মীয়। একজন বিচারক কোনো কোম্পানির চেয়ারম্যান বা পরিচালক এবং কোনো ক্লাবের নেতা হলেও তা আচরণবিধির লঙ্ঘন হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ ছিল।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অসদাচরণের সংজ্ঞা হিসেবে এসব বিষয় অবশ্যই আইনে থাকতে পারে। আইন কমিশন বাদ দিলেই যে সেগুলো আইনে থাকতে পারবে না, এমন কোনো কথা নেই।’ এর পাশাপাশি বিচারকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বা তুচ্ছ অভিযোগ করলে বা তাঁদের বিরক্তিকর হয়রানি করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখার কথা বলা ছিল ওই খসড়ায়।
আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের কেউ কেউ মনে করছেন, আইন কমিশন বিচারকদের আচরণবিধি-সংক্রান্ত এসব সুনির্দিষ্ট বিষয় বাদ দেওয়ায় আইনটি দুর্বল হয়ে পড়বে। তাঁদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিচারক সম্পর্কে স্পর্শকাতর যেসব কথা শোনা যায় বা যে ধরনের আলোচনা হয়, তাতে আইনে বিষয়গুলো উল্লেখ থাকলে ভালো হতো।
মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা খসড়া আইন কমিশনে ব্যাপক কাটছাঁট হওয়া প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, এটা নিয়ে এখন বিস্তারিত কথা বলা ঠিক নয়। কারণ, আইনটি সম্পর্কে অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুটি খসড়াই দেখেছি। আইন কমিশন যে খসড়াটি করেছে, সেটি আমার কাছে সহজ মনে হয়েছে এবং আমি বলব, বিচারকদের অধিকার সুরক্ষায় আইন কমিশন দৃঢ়তা দেখিয়েছে।’
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি সব সময় বলি, যেখানে দুটি পক্ষ, সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সর্বোচ্চ সুযোগ থাকা উচিত। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিচারপতিরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ পাবেন বলে আমার মনে হয়েছে।’
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অবশ্য মনে করেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নে দুটি আলাদা আইন করতে হবে। তিনি বলেন, একটির মাধ্যমে বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের প্রক্রিয়া এবং আরেকটির মাধ্যমে সংসদে বিচারকদের অপসারণ-সংক্রান্ত পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হবে।
বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার জন্য অবশ্যই আইন প্রণয়ন করা উচিত বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, ‘তবে কর্মরত বিচারপতিদের বাসায় তাঁর আইনজীবী ছেলেমেয়ে বা স্বজনদের চেম্বার থাকা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। আর শুধু বিচারপতি কেন, সাংবিধানিক সব পদধারী ব্যক্তির সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া উচিত। তাহলে তাঁদের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না।’
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন খসড়ায় কে তদন্ত করবে, কীভাবে তদন্ত হবে—এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তিন সদস্যের কমিটি তদন্তের পর প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে জমা দেবে। ওই প্রতিবেদনের ওপর জাতীয় সংসদে আলোচনা হবে। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতিতে অভিযুক্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি অপসারণের চূড়ান্ত চিঠিতে সই করবেন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের নিয়মটি সংবিধানে এ পর্যন্ত তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। সংবিধানের ৯৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ভোটে সমর্থিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে। আর ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, অপসারণের প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তবে ওই অনুচ্ছেদ অনুসারে আইন আজ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। এর মধ্যে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৯৬ (২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। আর আইন-সংক্রান্ত ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়।
১৯৭৭ সালে বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিতে আবার পরিবর্তন আসে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে ঢুকে যায়। ২০১০ সালে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনা হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ পড়েনি।
প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের দুজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতা ছিল কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করার। কাউন্সিলের তদন্ত প্রতিবেদনে যদি বিচারককে অপসারণের সুপারিশ করা হয়, তবে রাষ্ট্রপতি তাঁকে অপসারণ করতে পারতেন।
২০১২ সালে তৎকালীন হাইকোর্ট বিভাগের ও পরে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিচারপতিদের অপসারণের পদ্ধতি আবার সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি ওঠে। ওই সময়ে স্পিকার ও বর্তমানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে নিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিনের একটি মন্তব্যের সূত্র ধরে কয়েকজন সংসদ সদস্য তাঁকে অপসারণের দাবি তোলেন। এরপর ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের হাতে ফিরে যায়, সেই সঙ্গে অভিযোগ তদন্তের জন্য আইন প্রণয়নের দাবি ওঠে। তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, খুব শিগগির এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হবে।
অবশ্য ষোড়শ সংশোধনীর পরপরই ২০১৪ সালের নভেম্বরে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিধান চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট হয়। প্রাথমিক শুনানির পর আদালত রুলও দেন, যার শুনানি এখনো শেষ হয়নি। -প্রথম আলো
Discussion about this post