মন্ত্রিসভা অনুমোদিত ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’ এর খসড়াটি আইনে রূপান্তর করার আগে এ বিষয়ে বিচারপতিদের মতামত বাঞ্ছনীয় বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এ আইনের খসড়ায় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগকারীর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সোমবার (২৫ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনের পর নিজ কার্যালয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী।
তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা আইনের খসড়াটি নীতিগত অনুমোদন দেওয়া মানে এই না, ওনারা (বিচারপতি) কোনো পরিবর্তন চাইলে তা হবে না। যুক্তিসঙ্গত পরামর্শে পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, এ রকম আইনে তাদের (বিচারপতিদের) মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আইনে নেই। কিন্তু এটা যেহেতু তাদের ব্যাপার, তারাই একমাত্র স্টেকহোল্ডার, তারা (বিচারপতিরা) পাবলিকলি এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন না। সেহেতু আমি মনে করি, তাদের অভিমত নেওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
এর আগে খসড়াটি তাদের কাছে দেওয়া হলেও বিচারপতিরা কোনো মতামত দেননি। তবে তাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকবেন বলেও জানান আইনমন্ত্রী।
মিথ্যা অভিযোগের বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, যদি কেউ কোনো মিথ্যা অভিযোগ করেন এবং সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে তারও শাস্তির বিধান রয়েছে। এটি দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
আইনমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তার নাম উল্লেখ এবং ঘটনার সত্যতার দায়িত্ব নিয়ে অভিযোগ করতে হবে। কোনো কারণে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীকে শাস্তি পেতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও যদি কেউ অভিযোগ করেন, তার ক্ষেত্রে একই বিধান প্রযোজ্য।
আনিসুল হক বলেন, গত ২ মার্চ আইন কমিশনের এ খসড়াটি প্রধান বিচারপতির কাছে আমি নিজ হাতে তুলে দিয়েছি এবং আনুষ্ঠানিকভাবেও পাঠিয়েছি। ওখান থেকে কোনো মতামত না আসায় একটা রিমাইন্ডার দিয়েছিলাম। তার জবাবে তারা বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়েছে। যেহেতু এ মামলা এখনো চলছে এবং আগামী ৫ মে রায় হবে, সেহেতু এ আইনের ব্যাপারে আমরা অভিমত দিতে পারি না’।
‘সেটাকে সম্মান করি। আজ (সোমবার) মন্ত্রিসভা থেকে এ আইনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মন্ত্রিসভার অংশ শেষ হলো। তবে বিচারকদের অভিমত নেওয়ার যে সুযোগ ছিল, তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তারাই যেহেতু একমাত্র স্টেকহোল্ডার, আইনটাই করা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ব্যাপারে, তাই তাদের সঙ্গেই আমরা আলাপ-আলোচনা করবো। তারা যে সাজেশন দেন, তা নিশ্চয়ই আইন প্রণয়নের সময় বিবেচনা করবো’।
আইনমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের আইন অনেকদিন আগে করা উচিত ছিল। করা হয়নি। এর ফলশ্রুতিতে- আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানে যখন ৯৬ অনুচ্ছেদ যখন ছিল, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কোনো সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে রিমুভ করা হয় নাই। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে অন্ততপক্ষে ৮-৯ জন বিচারপতিকে রিমুভ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বিচারপতি কেএম সোবহান, বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি এসএম হোসেন- এ তিনজনকে বলা হল- ‘আজ থেকে আপনারা তিনজন বিচারপতি নন। হয় পদত্যাগ করুন, নইলে চাকরি খাবো’। এ হুমকি তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল।
আবার বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সকালে তার এজলাসে মামলা চলছে। রেজিস্ট্রার সাহেব আইনজীবীরা যেখানে দাঁড়ান, সেখানে গিয়ে তাকে একটা ফোন করা হল কোথা থেকে- ‘মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আজকের পত্রিকা তিনি পড়েছেন কি-না। যদি পড়ে থাকেন, উনি কি আছেন?’ তখন রেজিস্ট্রার প্রধান বিচারপতিকে গিয়ে বললেন, ‘আপনি আজকে একটু এডজর্ন করুন’। তিনি বুঝতে পেরেছেন। কারণ, রেজিস্ট্রার এসে জিজ্ঞাসা করছেন। এরপর কোর্ট এডজর্ন করে তার খাস কামরায় গিয়ে তাকে পত্রিকাটা দেওয়া হল। ‘মার্শাল ল’র আজকে যে আইনটা করা হয়েছে, এটা পড়ে আপনি একটু দেখুন, আপনি আছেন কি-না?’ সেটা পড়ে দেখা গেলো তিনি নাই।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে আইনমন্ত্রী বলেন, আমারও সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য- আমার বাবা তখন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তাকে খবর দিয়ে দ্রুত অ্যারেঞ্জমেন্ট করে প্রধান বিচারপতিকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হল। এটা হচ্ছে, কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অসম্মান করে বিদায় করা। এটা হচ্ছে, দি হাইট অব আর্বিট্রেইনেস।
তিনি বলেন, আমরা মনে করলাম যে, মাননীয় বিচারপতিদের অসম্মান করতে আর দেওয়া যেতে পারে না। তাদের অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের।
আনিসুল হক বলেন, এ আইনের খসড়ায় অভিসংশনের কথা বলা হচ্ছে না। প্রমাণিত অসমর্থতা আর অসদাচারণের ক্ষেত্রে তাদেরকে বিদায় করার কথা বলা আছে।
পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি জানান, এ আইনের মধ্যে আছে প্রথমে স্পিকারের কাছে একজন নালিশ করবেন। স্পিকার ১০ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে একটা প্রাথমিক তদন্ত করাবেন। সে তদন্তে যদি প্রমাণিত হয়- এটার কোনো ভিত্তি নেই, তাহলে এটা আর এগোবে না। তবে ভিত্তি আছে মনে হলে –তিনি এটা সংসদে আলাপ-আলোচনা করবেন।
যেহেতু এটা একজনের মান-সম্মানের ব্যাপার, দরকার হলে সংসদে ক্যামেরা আলোচনায় হবে।
এরপর তদন্তের কথা পাস করা হলে একটা স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠন করা হবে। যেখানে একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, একজন প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন সুশীল সমাজের সদস্য থাকবেন। এখানে কোনো এমপি নাই, কোনো সরকারের কেউ নাই।
এ তদন্তের সময় যে বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, তার লিখিত এবং উপস্থিত হয়ে মৌখিক বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ থাকবে। এ তদন্ত শেষ হওয়ার পর তা সংসদে যাবে। সংসদেও ওই বিচারপতির লিখিত এবং মৌখিক বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ থাকবে। তার মানে প্রতিটি ধাপে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকবে। এবং তারপর অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংসদে দ্বিতীয়বার আলোচিত হবে। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি মনে করেন, ওই বিচারপতিকে অপসারণ করা হবে, সেই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করলে তিনি অপসারিত হবেন।
Discussion about this post