সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেওয়ায় বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা বর্তমানে কার হাতে ন্যস্ত, সে বিষয়টি এখনও মীমাংসা করা হয়নি। রিটকারী আইনজীবীসহ সিনিয়র আইনজীবীদের অনেকেরই দাবি, এ রায়ের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ক্ষমতা ‘অটোমেটিক্যালি’ চলে গেছে। যদিও রাষ্ট্রপক্ষেরসহ অনেক আইনজীবীই বলছেন, এভাবে ‘অটোমেটিক্যালি’ কিছু পুনঃস্থাপিত হয় না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ফিরতে হলেও অন্তত একটি প্রজ্ঞাপন জারি প্রয়োজন।
গত ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকছে না বলে রায় ঘোষিত হয়। এই ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে এর আগে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল সর্বোচ্চ আদালত খারিজ করে দেওয়ার পরই শুরু হয় বিতর্ক। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলছেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপিত হয়নি। কীভাবে অপসারণ হবে সেই বিষয়ে নতুন কিছু হয়তো হবে।’
এদিকে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ মনে করেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের যে ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া হয়েছিল আপিল বিভাগের রায়ের ফলে এখন তা অকার্যকর হওয়ার পাশাপাশি ‘অটোমেটিক্যালি’ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল চালু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আশা করছি পূর্ণাঙ্গ রায়ে ব্যাখ্যা থাকবে।’
রিটকারী আইনজীবী আরও বলেন, ‘কোনও আইন বাতিল করে নতুন আইন হওয়ার পর সেটি যদি আদালতে চ্যালেঞ্জ হয় এবং আদালত কর্তৃক যদি ওই আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষিত হয়, তাহলে আগের আইনই বলবৎ হবে।’
এর আগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের দিনই এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শুনানিতে অংশ নেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় আগের অবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থাই বলবৎ বলে ধরে নিতে হবে।’
এদিকে সংশোধনী বাতিল হলে আগের অবস্থান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ফিরে যাওয়া হবে বিষয়টি মানতে রাজি নন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, ‘এটিএকেবারেই ঠিক ব্যাখ্যা নয়। আগেও বলেছি, এই রায়ের পর বিচারপতি অপসারণে এখন শুন্যতা দেখা দিয়েছে।’
রায় ঘোষণার পর বিচারক অপসারণ ক্ষমতা তাহলে কার কাছে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে না, এটা বলতে পারি। আমার মতে এভাবে পুনর্বহাল হয় না। সংবিধানের যে অনুচ্ছেদ সংসদ বাতিল করেছে সেটা আপনাআপনি রেস্টর (পুনঃস্থাপন) হবে না। সংসদের কাজ তো আর কোর্ট করতে পারে না।’
রায়ের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপন হয়ে যায়নি উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপন হয়ে গেছে এটা ভাবার আইনত কোনও সুযোগ নেই। সরকারকে কোনও নতুন আইন বা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পদ্ধতি কী হবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে।’
১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট-এর ‘ইফেক্ট অব রিফিল’-এর ধারণা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অটোমেটিক্যালি পুনঃস্থাপন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার কোনও একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা উল্লেখ করে দিচ্ছে। আর অন্য কোনও আইন করতে চাইলে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।’
সর্বোচ্চ আদালত যদি ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর হবে ঘোষণা দিতো, সেক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়ে যেতো বলে অনেকে বলার চেষ্টা করছেন। এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আদালত ডিক্লেয়ার করতে পারে না। লেজিসলেশনের ক্ষমতা আদালতের নেই। যদি ঘোষণা করতেন সেটিও সঠিক হতো না।’
এখন সুরাহা কী হবে প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবে আলম বলেন, ‘এখন এক ধরনের শূন্যতার মধ্যে আছি আমরা। দেখা যাক সরকার কী পদক্ষেপ নেয়।’
এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘যা হয়েছে এরপর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপিত হয়েছে এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। বিচারক অপসারণের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হবে না, নতুন কিছু আসছে। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
বিচারকদের পদের মেয়াদ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বিল অনুসারে, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দুই দফায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়। এতে বলা হয়, ‘প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনও বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’
ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিন জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলে গেলেও সেই রায়ই বহাল থাকে।
সুত্র বাংলা ট্রিবিউন/উদিসা ইসলাম
Discussion about this post