ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতিদের নিয়োগ ও বদলির অধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপকে সরাসরি খারিজ করলেন।
শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের কনস্টিটিউশন বেঞ্চ এক যুগান্তকারী রায়ে জানিয়ে দেন, বিচারপতি নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আইন করে যে কমিশন গঠন করেছিলেন, তা সংবিধান বিরোধী। সেই আইনের মাধ্যমে সরকার বিচার বিভাগের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে।
সুপ্রিম কোর্ট জানান, গত দু দশক ধরে যে কলেজিয়াম পদ্ধতিতে সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্ট গুলির বিচারপতিদের নিযুক্তি ও বদলি হয়ে আসছে, সেই ব্যবস্থাই জারি থাকবে। তবে কলেজিয়াম পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি থাকলে, তা শোধরানো হবে। সর্বোচ্চ আদালত জানান, ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সেই সুপারিশ বা পরামর্শ শুনবেন।
বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ নতুন নয়। বিজেপি ক্ষমতায় এসে এই নিয়োগ স্বচ্ছতর করতে এক নতুন আইন তৈরি করে। সেই আইন মোতাবেক গঠিত হয় ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন (এনজেএসি)। কমিশনের মোট সদস্য সংখ্যা ছয়জন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, সর্বোচ্চ আদালতের সবচেয়ে সিনিয়র দুই বিচারপতি, দেশের আইনমন্ত্রী এবং দুই বিশিষ্ট আইনবিদকে নিয়ে এই কমিশন গঠিত হবে। দুই বিশিষ্ট আইনবিদকে বেছে নেবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের প্রধান বিরোধী দলের নেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে এই ৯৯ তম সংবিধান সংশোধন বিলটি পাস হয়ে আইনে রূপান্তরিত হয়। শুধু তাই নয়, দেশের ২০টি রাজ্যের বিধানসভাও এই আইনকে অনুমোদন করে। আইন পাস হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেটস অন রেকর্ড অ্যাসোসিয়েশন ও অন্যরা। তাঁদের দাবি, এই আইন বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, যা ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। মামলা দায়ের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তু সরকারকে জানিয়ে দেন, বিচার শেষ না হলে তাঁর পক্ষে কমিশনের সদস্য হওয়া সম্ভবপর নয়।
প্রধান বিচারপতি সরে দাঁড়ানোয় বিচারপতি কে এস খেয়রের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কনস্টিটিউশন বেঞ্চ এই মামলা শোনেন। শুক্রবার ৪-১ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এনজেএসি খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেন, দু দশক ধরে সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ সিনিয়র বিচারপতিদের যে কলেজিয়াম বিচারপতি নিয়োগ করে আসছেন, সেই পুরোনো পদ্ধতিই বলবৎ থাকবে। পদ্ধতির উন্নতিতে কোনো সুপারিশ বা পরামর্শ থাকলে তা ৩ নভেম্বর শোনা হবে।
এই রায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের কাছে এক বিরাট রাজনৈতিক ধাক্কা। বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে বিজেপির দুই আইনজীবী নেতা অরুণ জেটলি ও রবিশঙ্কর প্রসাদ কলেজিয়াম পদ্ধতির বদল ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
রায়ের পরে বিস্মিত রবিশঙ্কর বলেন, বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বহু অভিযোগ উঠেছে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এই নিযুক্তির বিষয়টিকে স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করা। রবিশঙ্কর বলেন, সুপ্রিম কোর্ট নিজেই স্বীকার করেছেন কলেজিয়াম পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকলে তা শোধরানো হবে। সরকার সেই ত্রুটি শুধরেই এই বিল এনেছিল।
আইনমন্ত্রী সদানন্দ গৌড় বলেন, এনজেএসি আইনে জনগণের অভিমতই প্রতিফলিত হয়েছে। সংসদের দুই কক্ষের একশ শতাংশ রায় রয়েছে এই বিলে। ফলে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরই সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ করবে।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে দেশের আইন বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা জানিয়েছেন, বিষয়টিকে এইভাবে দেখা ঠিক হবে না। বরং গণতন্ত্রের তিন স্তম্ভ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় সাধনই কাম্য।
বিজেপিকে কটাক্ষ করে সুরজেওয়ালা বলেছেন, এই রায় এক দিক থেকে সরকারের প্রতি সুপ্রিম কোর্টের অনাস্থারই সামিল। কংগ্রেস অবশ্য বলেছে, এটা সুখের কথা, কলেজিয়াম পদ্ধতি যে ত্রুটিমুক্ত নয় তা সুপ্রিম কোর্টই স্বীকার করেছেন।
Discussion about this post