ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এক বছরের মাথায় মামলার জট কমেছে প্রায় ৮০ হাজার। অযথা তদবির এড়াতে বিচারের ক্ষেত্রে নেয়া হয়েছে অভিনব কৌশল। দ্রুত নকল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া মালখানা ব্যবস্থাপনা, রেকর্ড সংরক্ষণ, হাজতখানার উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। সর্বত্র লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এর সুফল ভোগ করতে চলেছেন বিচারপ্রার্থীরা।
আদালতের এ পরিবর্তনের ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি আবু বকর ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে বর্তমান সিএমএমের পদক্ষেপগুলো যথাযথ ও সময়োপযোগী। তবে এ উদ্যোগগুলোর নিয়মিত সুষ্ঠু তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এসব ভালো উদ্যোগ যেন কিছুদিন পর হারিয়ে না যায়। এ জন্য সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে।’
মামলা নিষ্পত্তি: গত বছরের আগস্টে বর্তমান সিএমএম শেখ হাফিজুর রহমান যোগদানের সময় এ আদালতে ৩ লাখ ৩ হাজার ৪১৮টি মামলা বিচারাধীন ছিল। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই মামলার শ্রেণী ও প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে তিনি দ্রুত নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ নেন। এক বছর পর এ সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার কমে ২ লাখ ২৪ হাজার ৩টিতে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, যোগদানের পর সিএমএম প্রথমেই মোটরযান আইনে বিচারাধীন ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৫০টি মামলার দিকে নজর দেন। মোটরযান আইনের প্রসিকিউশন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখেন অধিকাংশ রিপোর্ট আইনত ত্র“টিপূর্ণ। আসামি ও অভিযোগকারীর নাম, ঠিকানা, ঘটনাস্থলের বিবরণ, সাক্ষীদের নাম প্রসিকিউশন রিপোর্টে নেই। সিএমএম এ ধরনের মামলাগুলো আইনানুগ পথে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এরপর গত জুলাই পর্যন্ত মোটরযান আইনের ১ লাখ ২২ হাজার ২৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
এ ছাড়া দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি প্রতিটি আদালত থেকে মামলার পরিসংখ্যান তলব করেন। এরপর পুরনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেন। সাক্ষী হাজির না করায় অধিকাংশ ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্ব ঠেকাতে তিনি নানামুখী পদক্ষেপ নেন। ডাক্তার ও পুলিশ যারা একাধিক মামলার সাক্ষী, সেসব মামলা চিহ্নিত করেন। ওই মামলাগুলো একই তারিখে শুনানির দিন ধার্য এবং একই দিনে যাতে সাক্ষ্য গ্রহণ হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতগুলোকে নির্দেশনা দেন। ফলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং আদালতের কর্মঘণ্টার অপচয় রোধ হয়। এসব উদ্যোগের ফলে মামলা নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
বিচারে অভিনব উদ্যোগ: মামলার বিচারের ক্ষেত্রে এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন ঢাকার বর্তমান সিএমএম। জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তিনি প্রতিদিন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের রিমান্ড ও জামিন শুনানির অধিক্ষেত্র পরিবর্তন করেন। সকাল ১০টায় বিচার শুরুর আগ পর্যন্ত কোনো পক্ষই জানতে পারেন না তার মামলার বিচার করবেন কোন বিচারক। এই কৌশলগত পরিবর্তনের ফলে বিচারে অহেতুক হস্তক্ষেপ ও দালাল-টাউটদের দৌরাত্মা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এর আগে রিমান্ড ও জামিন শুনানির অধিক্ষেত্র সপ্তাহ শেষে একবার পরিবর্তন হতো। এ ছাড়া প্রতিটি আদালতের আদেশ প্রতিদিন প্রয়োজনমতো তিনি পর্যালোচনা করে থাকেন। কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
অনুলিপি বিভাগ: ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রতিদিন রায় ও আদেশের অনুলিপির জন্য বিপুলসংখ্যক আবেদন দাখিল হয়। জনবল সংকটের কারণে এই বিপুলসংখ্যক আবেদন নিষ্পত্তিতে অনেক সময়ই জটিলতা তৈরি হয়। বর্তমান সিএমএম দায়িত্ব নেয়ার পর নকলখানা পরিদর্শন করে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। তার দিকনির্দেশনার ফলে নকল প্রদানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২২০টি আবেদনের বিপরীতে ১৮০ থেকে ২০০টি নকল প্রদান করা হয়ে থাকে বলে সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
রেকর্ডরুমের আধুনিকায়ন: ২০০৮ সালের পর দীর্ঘদিন ধরে সিএমএম আদালতের রেকর্ডরুমের নথি অবিন্যস্ত অবস্থায় ছিল। বর্তমান সিএমএম দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে রেকর্ডরুম আধুনিকায়নে হাত দেন। রেকর্ডরুমসহ সংশ্লিষ্টদের একটি পূর্ণাঙ্গ রেজিস্টার তৈরির নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে রেকর্ডসম্পর্কীয় তথ্য ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন।
হাজতখানা: সিএমএম আদালতের হাজতখানায় প্রতিদিন প্রায় ৬০০ আসামি আসেন। অনেক সময় আসামির সংখ্যা বেড়ে যায় এবং হাজতখানায় স্থান সংকুলান হয় না। শিশু ও মহিলাদের জন্য পৃথক কক্ষ প্রয়োজন। বর্তমান সিএমএম কয়েদিদের জন্য নিরাপদ পানি এবং শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পানকক্ষ নির্মাণ, হাজতিদের পরিচ্ছন্ন বাথরুম সুবিধা নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ নিয়েছেন।
মালখানা: মামলার আলামত মালখানায় সংরক্ষণ করা হয়। বিপুলসংখ্যক আলামতের কারণে মালখানায় নতুন আলামতের স্থান সংকুলান হয় না। অনেক সময়ই আলামত থানায় রাখতে হয়। সাক্ষীকে পরীক্ষাকালে অনেক সময় থানায় রাখা আলামত আদালতে উপস্থাপন সম্ভব হয় না। তখন সাক্ষ্য গ্রহণ মুলতবি রাখতে হয়। বর্তমান সিএমএম এ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি কর্তৃপক্ষকে সমস্যাগুলো লিখিতভাবে অবগত করেছেন এবং মালখানা রেজিস্টারগুলো হালনাগাদ ও পূর্ণাঙ্গ করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
নিরাপত্তা জোরদার: ঢাকার সিএমএম আদালতের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশি টহল বাড়ানোর পাশাপাশি পুরো আদালত চত্বরের বিভিন্ন স্থানে সিসি টিভি ক্যামেরা বসিয়ে তা সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আদালতের প্রবেশপথে পুরনো আর্চওয়ের পাশাপাশি দুটি নতুন আর্চওয়ে বসানো হয়েছে। সূত্র: যুগান্তর।
Discussion about this post