বিচার বিভাগে বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি কমছে। সম্প্রতি বিচার অঙ্গনে অভিযোগ বাক্স স্থাপন, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পরিচয় প্রদর্শনে সার্কুলার, ডিজিটাল ডাটাবেজ, মোবাইলে অ্যাপস চালু ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার শুনানির উদ্যোগ নেয় উচ্চ আদালত। এতে করে বিচার প্রার্থীদের সুবিধা বাড়ছে। এছাড়াও দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিতদের আইনি সেবা প্রদান করার জন্য সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে চালু করে লিগ্যাল এইড সার্ভিস সেন্টার।<br /> ফলে আদালতে আসা বিচার প্রার্থীদের যেমন ভোগান্তি কমছে তেমনি বিচারিক কার্যক্রম আরো গতিশীল হচ্ছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।<br /> অভিযোগ বাক্স স্থাপন: বিচার বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম দূর করতে স্থাপন করা হয় অভিযোগ বাক্স। চলতি বছরের এপ্রিলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সামনে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা হয়। উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাক্সে বিচারপ্রার্থী জনগণ দেশের আদালতগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম এবং দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ সম্বলিত চিঠি ফেলতে পারবেন। বাক্সটি স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হল, বিচারপ্রার্থী জনগোষ্ঠীকে আইনি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দাফতরিক ও বিচারিক সেবার মানোন্নয়ন করা। এছাড়া যে কোনো নাগরিক বিচারপ্রার্থী জনগণের সমস্যা লাঘবে বিশ্লেষণধর্মী মতামতও পাঠাতে পারবে। বাক্সে বিচারপ্রার্থী জনগণ, আইনজীবী ও সাধারণ জনগণ নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে লিখিতভাবে নিজস্ব মতামত, পরামর্শ, অভিযোগ ইত্যাদি প্রকাশ করতে পারবেন। একজন অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার/স্পেশাল অফিসারকে প্রধান করে ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রারের সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি অভিযোগ বাক্স ব্যবস্থাপনার জন্য গঠন করা হয়।<br /> জানা যায়, গত ৫ মাসে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম এবং দায়িত্বে অবহেলার ৬০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৩২টি অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাকিগুলো নিষ্পত্তির পর্যায়ে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সম্পর্কিত ১০টি, সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ১০টি, অধস্তন আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে ২৫টি, অধস্তন আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ৬টি এবং বিবিধ ৯টি অভিযোগ জমা পড়ে।<br /> নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিযোগকারী বলেন, নাম গোপন রেখে আমিও একটি অভিযোগ করেছিলাম। অভিযোগ করার কিছুদিন পরেই প্রতিকার পেয়েছি।<br /> পরিচয়পত্র প্রদর্শনে সার্কুলার : আদালতে বিচার প্রার্থীদের হয়রানি ও ভোগান্তি দূর করতে বিচার অঙ্গনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয় পত্র প্রদর্শনে সার্কুলার জারি করে উচ্চ আদালত। গত ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করেন। এতে বলা হয়, আদালত অঙ্গন ও আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের যথাযথ নিরাপত্তা বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নিকট অতীতে আদালত অঙ্গনে নাশকতা সংঘটনের দ্বারা বিচারক ও আইনজীবীগণের প্রাণনাশের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে কারণে বিচারালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের নিমিত্তে আইনজীবীদের ছদ্ম পরিচয়ে অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিদের আদালত অঙ্গনে প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরী। এছাড়া আইনজীবীদের ছদ্ম পরিচয়ে অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিদের আদালত অঙ্গনে প্রবেশের ফলে মামলার আদেশ/রায়ের সার্টিফাইড কপি জালিয়াতিসহ নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর আগে চলতি বছর ২১ জুলাই এক নির্দেশনায় বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতীত বহিরাগত (উমেদার) কাউকে দিয়ে মামলার নথিতে কোনো ধরনের আদেশ বা মামলা সংক্রান্ত কোনো নোট লেখানো যাবে না। এ বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে এজলাসে বিচারক ও আইনজীবীদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে।<br /> ডাটাবেজ : জনপ্রশাসনের মতো বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি এ লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। সারা দেশের জেলা ও দায়রা জজদের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে স্মারকটি পাঠিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ফয়সাল আতিক বিন কাদের। এর আগে ৩০ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ডাটাবেজ তৈরির কথা বলেন। এরপর আইন মন্ত্রণালয় ওই উদ্যোগ নেয়।<br /> জানা যায়, সারাদেশের প্রায় ১৬শ’ ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকের তথ্যসমৃদ্ধ ডিজিটাল ডাটাবেজ সিস্টেমের উদ্যোগ নেয় সুপ্রিম কোর্ট। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সকল কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক তথ্য সন্নিবেশিত করে প্রস্তুত করা হচ্ছে ডাটাবেজ। বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়ম কমানোই এ উদ্যোগের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয় ডাটাবেজ তৈরির কাজ। এছাড়াও বিচার প্রার্থীদের বিচার কার্যক্রমের যাবতীয় তথ্য সহজে পেতে চালু করা হয়েছে মোবাইল অ্যাপস। গত মাসে প্রধান বিচারপতি ঢাকার তিনটি বিচারিক আদালতের দৈনন্দিন কার্যতালিকার মোবাইল অ্যাপ চালু করেন। এতে করে ঢাকার নিম্ন আদালতের দৈনন্দিন কার্যতালিকা ও মামলা নিষ্পত্তির তথ্য এখন মোবাইল ফোন থেকেই জানা যাবে। এতে মামলার পরবর্তী তারিখ ও দৈনিক মামলা নিষ্পত্তির তথ্য ও মামলার রায়ের তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়াও বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট জনগণকে মোবাইল ফোনে মামলার সব তথ্য জানানোর জন্য নতুন অ্যাপ চালু করা হয়। এছাড়াও সুবিধাবঞ্চিতদের আইনি সেবা প্রদানের জন্য সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে লিগ্যাল এইড সার্ভিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার শুনানি, আদালতের বিচার কার্যক্রমের সময় বৃদ্ধি, নিম্ন আদালতের সর্বশেষ মামলার তথ্যসমূহ উচ্চ আদালতকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।<br /> এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান বিচারপতির একান্ত উদ্যোগে এসব উদ্যোগ। এতে একদিকে যেমন বিচার বিভাগের কার্যক্রম গতিশীল হচ্ছে অন্যদিকে বিচার প্রার্থীরা সহজে সুবিধা পাচ্ছেন।</p>
Discussion about this post