আলোচিত মাজদার হোসেন মামলার রায় ঘোষণার ৮ বছর পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ কার্যকর হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নেওয়া যুগান্তকারী এই পদক্ষেপের পর ৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে রায়ে দেওয়া ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে কিছু বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু বিষয় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ৯ বছর পূর্তিতে মাজদার হোসেন মামলার রায়ের মৌলিক অংশের কতটুকু বাস্তবায়ন হলো সেই নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো।
বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে ১৯৭২ সাল থেকেই। দেশে একাধিকবার সামরিক হস্তক্ষেপ হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অঙ্গীকার থেকে সরে আসেনি কেউ। বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হলে নিয়োগ, শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বমুক্ত রাখার মতো বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকার সেভাবে কার্যকরের উদ্যোগ নেয়নি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও এর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সংবিধানের উল্লেখযোগ্য বিধানগুলোর মধ্যে ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে।” বিচারকগণ কর্মে স্বাধীন হবেন সে কথাও বলা হয়েছে ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদে। যাতে বলা হয়েছে, “এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।”
সংবিধান ও মাজদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের যাত্রা শুরু হয়। বেতন স্কেল বৃদ্ধি সংক্রান্ত কারণে মামলাটি দায়ের হয়েছিল। তবে সেই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বিষয়ে ঐতিহাসিক ১২ দফা নির্দেশনা আসে।
১৯৮৯ সালে সরকার বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কিছু পদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করে। এতে অন্য ক্যাডারদের সঙ্গে অসঙ্গতি দেখা দেয়। তৎকালীন সরকার এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য ১৯৯৪ সালের ৮ জানুয়ারি জজ আদালতের বেতন স্কেল বাড়িয়ে দেয়। তবে প্রশাসন ক্যাডারের আপত্তির মুখে সরকার ওই বর্ধিত বেতন স্কেল স্থগিত করে।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জুডিশিয়াল সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাজদার হোসেনসহ ৪৪১ জন বিচারক ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট পাঁচ দফা সুপারিশসহ ওই মামলার রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার ঐতিহাসিক রায়টি দেন।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পরবর্তী বিএনপি সরকার এই রায় বাস্তবায়নের জন্য বারবার সময় নিতে থাকে। তাই আওয়ামী লীগ তাদের প্রায় দেড় বছর সময়ে ও বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট পাঁচ বছর সময়ে রায় বাস্তবায়নে সেভাবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগের নির্দেশনায় ২০০৭ সালের ১৬ জানুয়ারি চারটি বিধিমালা জারি করে। যার মধ্যে রয়েছে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলাবিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলী) বিধিমালা, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (পে-কমিশন) বিধিমালা জারি করা হয়।
তবে এসব বিধিমালা কার্যকরের জন্য ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই অনুযায়ী বিধির ৪, ৬, ৮, ৯, ১১, ১২, ১৭ (এ), ১৮, ২৯ (খ) ও (গ), ৩১, ৩৬, ৩৭, ৪১, ৪২, ৪৫ ধারাসহ বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়। যেসব সংশোধনীর মাধ্যমে ‘জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’ এর কাজকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ থেকে পৃথক করা হয়। আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতা খর্ব করা হয়। যদিও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এখনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ছোটখাট বিচার তাৎক্ষণিকভাবে করে থাকেন।
এসব বিধি প্রণয়ন ও ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধনের পর আইনগত ক্ষেত্রে খুব বেশি পদক্ষেপ নেওয়ার বাকি নেই বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের নির্দেশ মোতাবেক এবং পরবর্তীতে মাজদার হোসেনের মামলার আলোকে বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথক করা হয়। আইনগত তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বাকি নেই।
আইনগতভাবে স্বাধীন হলেও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই এখনো হয়নি। মামলা সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে গেছে, তার সাথে সাথে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু তাদের থাকার ব্যবস্থা, কার্যক্রম করার জন্য যে অবকাঠামো ও জনবল দরকার সেটা তারা পাচ্ছেন না।’
নিম্নআদালতের মতো সুপ্রিম কোর্টেও একই অবস্থা উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, ‘আপিল বিভাগে ১১জন বিচারক থাকার কথা, কিন্তু বসার অভাবে বা জায়গার অভাবে ৮জন বিচারক কাজ করছেন। অথচ ১১জন বিচারক থাকলে সুপ্রিম কোর্টে নিস্পত্তির অপেক্ষায় থাকা বিপুল সংখ্যক মামলার অনেকটাই সুরাহা হতো। একইভাবে হাইকোর্ট বিভাগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নতুন বিচারক নেওয়া হলে তাদের সঙ্গে কাজ করার জন্যও যোগ্য জনবলের অভাব রয়েছে। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ স্বাধীন করলে চলবে না। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক যা দরকার সেটা দিতে হবে। তখনই বিচার বিভাগ সত্যিকারার্থে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী সুবিচার প্রদান করতে পারবে।’
অনেকটা একই ধরনের অভিমত দেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার। তবে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ হওয়াটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আইনগত, নীতিগত ও সাংবিধানিকভাবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক। কিন্তু বিচার বিভাগকে পুরোপুরি পৃথকীকরণ করতে হলে আরো কতগুলো পদক্ষেপ নিতে হয়। এটি চলমান প্রক্রিয়া। সেসব পদক্ষেপ নিতে গেলে একটু সময় লাগবে।’
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে আইনগতভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বাকি নেই- এই বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনও। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আইনত বিচার বিভাগ স্বাধীন করা হয়েছে। কিন্তু এটাকে স্বাধীন রাখার যে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা তো করা হয়নি।’
আইনত পৃথক হলেও এখনও যে কার্যত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে সেকথা স্বীকার করছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। তবে সে সব বিষয় সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনাতেই কার্যকর হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
মাহবুবে আলম বলেন, ‘অলরেডি বিচার বিভাগ পৃথক হয়ে গেছে। পৃথকের সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে যিনি শাসন করবেন তিনিই বিচার করবেন না। এই কনসেপ্ট আর নাই। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এগুলো হয়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা যখন জেলে দিয়ে দিচ্ছেন, জরিমানা করছেন; এ জরিামানা কতটুকু আইনসঙ্গত হচ্ছে বা জেল দেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে কিনা এ নিয়ে এখনো নানারকম বিতর্ক আছে। এগুলো নিয়ে আদালতের সামনে রিসেন্টলি একটা মামলাও হয়েছে। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে হাইকোর্ট একটি (টাঙ্গাইলের সখিপুরের ইউএনও’র স্কুল ছাত্রকে দেওয়া সাজা বাতিল) মামলার রায়ও দিয়েছেন। আদালতের রায়ের মাধ্যমে এগুলো সলভ হয়ে যাবে।’
সংবিধান ও আইন অনুযায়ী যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হলেও জুডিশিয়াল সার্ভিসের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলী) বিধিমালা-২০০৭ এর ৬ ধারা অনুযায়ী সার্ভিসের সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্ত ও অপসারণ ব্যতীত শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে আলাদা প্রণীত হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য গভমেন্ট সার্ভেন্ট (ডিসিপ্লিন অ্যান্ড আপিল) রুলস ১৯৮৫ এর বিধানাবলী অভিযোজন সহকারে সার্ভিসের সদস্যদের শৃঙ্খলা বিধানের ব্যবস্থা করবে।
তবে শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধির একটি খসড়া আইন মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছিল। যেটিকে আপিল বিভাগ ‘জগাখিচুড়ি’ অভিহিত করেছেন। সেই বিধিটি মাজদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে চূড়ান্ত করে জারি করতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এই বিষয়ে আপিল বিভাগে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৬ নভেম্বর দিন ধার্য রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পরে বিচারকদের চাকরি ও শৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে মাজদার হোসেন মামলাতেই তারা এনেছেন। কিছু কিছু পয়েন্ট তারা এনেছেন সরকারের গোচরে নেওয়ার জন্য। সেটা প্রক্রিয়াধীন আছে।’ সূত্র: দ্য রিপোর্ট
Discussion about this post